অসাম্প্রদায়িক চেতনা
– সুবোধ চন্দ্র মন্ডল

হাত ধরাধরি করে চলেছেন হেঁটে শিক্ষক দুই জন
জ্ঞানের পথে সাধনার ক্ষেত্রে তাদের একই আদর্শ ও দর্শন
একজন হিন্দু, একজন মুসলিম – দুটি ভাই, বাংলাদেশের দুই আঁখি-তারা
এক বাগানে দুটি তরু, দেবদারু আর কদম-চারা।
ধর্ম আছে যার যার বিশ্বাসে, মানুষ হিসাবে সবাই সমান – এ এক অসাধারণ দৃশ্যময়
অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জ্বল এই দৃষ্টান্ত আজিকে ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়।
শাস্ত্র মতে – বেদ বলে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’,
ইসলাম বলে ‘লাশরীক আল্লাহ’,
বাইবেল বলে ‘গড ইজ ওয়ান’।
অতএব ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় – শুধু মাত্র নামের প্রকারভেদ।
কেন তবে ধর্মের নামে মানুষের মাঝে হবে মানুষের বিভেদ?
আমাদের স্বরূপ হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, খৃস্টান অথবা বৌদ্ধও নয় -
একই স্রষ্টার সন্তান আমরা, মানুষ আমরা – এই হোক আমাদের প্রকৃত পরিচয়।
চেনা গ্রাম হয় অচেনা
– সুবোধ চন্দ্র মন্ডল
গ্রাম আমাদের ‘হলদিবুনিয়া’ – লম্বা পাঁচ মাইল ব্যাপিয়া
মধ্যপাড়ার বাসিন্দা, মোদের বাড়ির নামটি ‘বড়বাড়ি’,
বাড়ির দক্ষিণ পার্শের ভিটে দুর্গাপুজো হতো পাঁচ দিন ধরিয়া –
অতীতের সেই উৎসবের ভিটে হয়ে আছে এখন পড়ো বাড়ি।
সেই অতীত আজ আর অক্ষত নয়,
চেনা অতীত কত সহজে অচেনা হয়ে যায়।
বাড়ির সামনের সেই কাঁচা রাস্তা, পেড়িমাটি, শাপলা পুকুর,
সেদিনের সেই পথ দিয়েই চলত সবাই সকাল দুপুর।
এখন আর নেই সেই কাঁচা পথ, হয়েছে পিচ ঢালা,
সবারই বেড়েছে ব্যস্ততা, তাই ২৪ ঘন্টাই এখন পথিকের পথচলা।
বেপারি খাল, দোঁয়নে খাল, বালে খালে – খালের উপর বাঁশের চার
পার হতাম ধরে শক্ত হাতে, বাহারী নামের সেই খাল এখন হতে হয় না কারুর পার।
প্রইমারী স্কুলের পাশে কত করেছি চিঠি পোস্ট, পোস্ট অফিস আর দেখিনা সেখানে
বাড়ির সমুখের সেই বিলে জোয়ার ভাটা আসেনা আর, তখন আসিত যেন প্রাণের টানে।
ভুলতে পারছিনা মালগাজিতে অহিলোদ্দির ঘোড়ার ছোপ -
এখনো হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরি সেই স্বপ্ন ছবির ঝোপ।
সেই স্বপ্ন সেই অতীত আজ আর অক্ষত নয়
চেনা অতীত কত সহজে অচেনা হয়ে যায়।
বাড়ির পূর্বে পশ্চিমে ছিলো বিশাল জোয়ার ভাটার বিল
আজ তার সামান্যতম চিহ্নও নাই একতিল
সারি সারি কত কেয়াকতুর আর কাঁটাবাগান গাছ,
লুকিয়ে থাকতো চেগাপাখি, ডাহুক কোড়া আর সাদা মাছ।
দেখতাম প্রতিদিন মনে আর ফনে বিলে গিয়ে ঘিরতো ঝোপ নানা ফান (ফাঁদ) দিয়ে
বেলা শেষে ফিরতো তারা থলেভরা নানা পাখি আর সাদা বক নিয়ে।
যতিন বাড়ই আর মনা বিশ্বাস এর বাড়ির সামনে পাঠশালা ছিলো দুটি,
ঐ পাঠশালায় রোজ সকালে পড়তে যেতাম সবাই মিলে, হতো না কোনো ত্রুটি
সেখানেই স্বরবর্ণ-১১টি আর ব্যঞ্জন বর্ণ-৩৯টি শিখে ছিলাম শিশুকালে।
গুরু মশাই শিখাতেন লেখাপড়া যত্ন করে – গ্রামের সেই পাঠশালে।
সেই অতীত আজ আর অক্ষত নয়,
চেনা অতীত কত সহজে অচেনা হয়ে যায়।
ফিরে দেখা চিলের হাট
– সুবোধ চন্দ্র মন্ডল
উনিশো সাতাত্তরে আঠাশে শ্রাবণ, সূর্য তখন পূর্ব পারে।
পশুর নদীর পূর্ব তীরে, হাট বসেছে রবিবারে।
তখন সপ্তাহে বসতো একটি হাট,
তাইতো হতো এত জমজমাট।
অতীতের সেই হাট হয়েছে এখন মলিন,
কালের স্রোতে ভেঙ্গে হয়েছে নদীগর্ভে বিলীণ।
হাটের দিনটির হয়নি কোন পরিবর্তন, এখনো সেই রবিবার
মূল জায়গা এখন আর যায়না চেনা, টেনে নিয়ে গেছে ব্রিজের উপর।
তখন চিলের খালের মোহনায়,
চালনা বাজুয়া থেকে মুদি দোকানীরা সব আসতো শত শত নৌকায়
বাঁশের খুটি মাটিতে পুঁতে বসতো তারা আলাদা করে।
বটগাছের সেই শীতল ছায়ায়, বেলে রাস্তার ধারে মাটির পরে,
নদীর তীরে বসতো লোকের মেলা – সে হাট এখন গিয়েছে সরে।
হাটুরেরা সব হাটে এসেছে, পদব্রজে আর নৌকা ভরে।
হাঁসে, কাঠা, কচ্ছপ চিৎভুট করে,
বেচাকেনা হত সারা দিন-সন্ধ্যাভর ধরে।
চট গুলো সেলাই করে, বেঁধেছে সব দড়ি দিয়ে,
তার উপর বসেছে সবাই, আলু বেগুন কাঁচামরিচ নিয়ে।
পালংশাখ উচ্ছে মুলো কুমড়ো কচু লাউ,
চাল ডাল তেল চিনি লংকা গুড়ো-মশলাও।
হাঁস মুরগী মাছ, আর ময়রার দোকানের মিষ্টি ছানা,
মাটির ঠিলে হাড়ি খুন্তি হাতা, নিয়ে চলে দর জানি জানা।
কেনাকাটা চলছে পুজোর বাজার,
কারো হাতে গামছা জামা, কারো হাতে ধুতি চাদর।
নৌকা চলতো পাল তুলে নদীর পশ্চিম তীর দিয়ে,
জোয়ার ভাঁটায় জেলেরা ধরতো মাছ নানা রকম জাল নিয়ে।
হাট ভেঙ্গে বেলা পড়ে গেলে সূর্যাস্তের রবি হত ডুবন্ত ,
হাটের কোলাহল যেতো থেমে, নিস্তব্ধতায় চারিদিক হতো শান্ত।
ভাঙ্গা হাটে সকলে ফিরে যেতো ঘরে,
নির্জন হাটে গাছের শাখায় তখন পাখিরা খেলা করে।
কবি পরিচিতি

সুবোধ চন্দ্র মন্ডল। জন্ম জানুয়ারী ১৫, ১৯৬৩, বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় হলদিবুনিয়া গ্রামে । বাবা স্বর্গীয় শ্রী অশ্বিনী কুমার মন্ডল এবং মাতা ঈশ্বর শ্রীমতি বিল্ল রানী মন্ডল। মোংলার সেন্ট পল্স উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে যথাক্রমে এস এস সি ও এইস এস সি পাশ করার পর খুলনা সিটি কলেজ থেকে ব্যচেলর অব সাইন্স এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওগ্রাফিতে মাস্টার অব সাইন্স অর্জন।
চাকরি জীবন কেটেছে এন জি ও সেক্টর এবং প্রাইভেট কোম্পানীতে। স্বেচ্ছায় অবসরের পর বর্তমানে ফরেক্স এবং ফ্রিল্যান্সিং-এ লিপ্ত। ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। স্ত্রীও একটি এন জি ও-তে চাকরি করছে এবং একমাত্র কন্যা সপ্তর্ষি মন্ডল অদিতি আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল ইনিস্টিটিউট থেকে ল্যবরেটরী সাইন্সে ডিপ্লমা শেষ করে এখন অনার্সে ভর্তি হবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ছেলেবেলা থেকে কবিতা পড়তে খুব ভালো লাগতো। তার লেখার অনুপ্রেরণা এই পড়া থেকেই। অনিয়মিত হলেও কখনো কখনো কবিতা বা গল্প লেখার চেষ্টা অভ্যাসগুলোর মধ্যে একটা। তবে নিজেকে কখন কবি বা গল্পকার হিসেবে দাবি করেন না – যা কিছু মন থেকে ভালো লাগে তাই লিখে ফেলেন ভালোমন্দ কিছু না ভেবেই।