আফরোজা হীরা – কবিতাগুচ্ছ – ২

সেবা

– আফরোজা হীরা

সেবার নামে ভণ্ডামি আজ
চলছে দেখো সারা দেশে,
সেবা নামক সোনার হরিণ
মিলবে কি হায় অবশেষে!

কি চমৎকার সেবা দেখো
দোকানিদের রংচঙা ওই পণ্যে লেখা
এই জাতিকে করবেই পঙ্গু
শপথ তাদের যায় না দেখা।

বিষ মেশানো ফল ফলাদি
মাছ মাংস আর সব্জি যত
সেবার নামে খাচ্ছি আর
করছি বসে লিভারে ক্ষত!

নিচ্ছি সেবা পরিবহণে
জীবনটাকে সঁপে দিয়ে
আত্নসম্মান লুটিয়ে দিয়ে
যাচ্ছি কোথায়… কে তা জানে!

যমের বাড়ি কত দূর আর
যানবাহনের দরজা থেকে?
জান নেবে সে, মান নেবে সে
থাকবে যারা অবশিষ্ট, তাদের দেবে সেবা তখন পকেট কেটে।

মূল ফটকে লেখা আছে – সেবার কথা
ওরা নাকি জনগণের বন্ধু,
ক্ষণিক বসে বুঝলাম শেষে
ওরে বাবা, এত দেখি সেবার সিন্ধু!

ভুলেও যদি গিয়েছ কভু
উকিলের ওই দরজার কাছে
পাবে সেবা সেই আশাতে!
মনে রেখো, খবর আছে।

কত দূর আর যাবে বাছা!
দিয়েছি সেবা কথা হাছা
এসো এবার হাতের মুঠোয়
রাখবো তোমায় ভরে কৌটোয়।

সেবার আশায় গেলাম আমি
সরকারি অফিসের ওই কামরায়,
মুচকি হেসে জানিয়ে দিলেন
মালপানি ছাড়া করবো কাজ! আমারে কি পাগলে কামড়ায়?

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, ভাবি আমি
সাদা পোশাকের অন্তরগুলো হবেই হবে সাদা নিশ্চয়,
পাবই পাবো সেবা এবার,
ধরলো যখন বুঝলাম আমি, মরা প্রাণে এবার কেমনে সই সেবার এ ভার!

সেবার নামে ভণ্ডামি আজ
চলছে দেখো সারা দেশে,
দশে মিলে রুখবে যেদিন এই অনাচার
মিলবে সেবা অবশেষে।।

রূপান্তর

– আফরোজা হীরা

আমি পুষ্প হয়ে ফুটেছিলাম
বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আমাকে কংক্রিট হতে হল।

আমি বহতা নদীর মত ছলাৎ ছলাৎ বয়ে গেছি কত দূর…
মাঝির কন্ঠে এই আমিই এনেছি, ভাটিয়ালির সুর।
রাখালের বাঁশীতেও সুর তুলেছি মধ্য দুপুরবেলা
সময়ের স্রোতে ধুয়ে গেছে কেবল মান অভিমানের খেলা।
চাঁদ হয়ে জোছনা বিলিয়েছি ঘোর সন্ধ্যেবেলা
রুদ্ধ বাতায়নের বাইরে দাঁড়িয়ে সয়েছি অবহেলা।
স্বর্ণলতা হয়ে নিবিড় আলিঙ্গনে বলতে চেয়েছি মনের ব্যথা
অহঙ্কারের উদ্ধত শিরে বোঝনি সে কথা।

আজ বিশ্বাসের সুতোয়া টান পড়েছে
ছিঁড়েছে বীণার তার,
অবিশ্বাসের ঘূর্ণি হাওয়ায় ওড়ে না সে ঘুড়ি আর।
আজ আর কোথাও এতটা ডুবে যাই না
যে নিজের অস্তিত্ব হারায়,
কেননা, বহু আগেই জেনে গেছি-
ডুবন্ত নৌকাকে তার মাঝিও ছেড়ে যায়…
স্বার্থের পৃথিবীতে ভালবাসাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ
জনে জনে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে তবেই হতে হবে শুদ্ধ!
এতটা কোথায় দায় পড়েছে! কেবল হতে দীঘির জল…
তার চেয়ে এই ঢের ভালো আলো আছি-
মাথার উপর তীক্ষ্ণ ফণা, কালনাগিনীর ছল।

আমি সূর্য হতে চেয়েছিলাম,
টিকে থাকার প্রয়োজনে আমাকে আগ্নেয়গিরি হতে হল।

তৈল কালির ফারাক

– আফরোজা হীরা

তৈল দিয়া লিখিলে-
দু’চারখানা পদক জুটিয়া যায় বৈকি!
উহার সহিত ঘৃত মিশাইলে
বাড়ি গাড়ি ও জোটে।
কিন্তু সত্য কহিতে হইলে
কালির বিকল্প আর কিছু হয় কি?

কালিতেই হয় পাপের ক্ষয়,
কালিতেই কমল ফোটে।
কালি হইলো সেই সে আঁধার
যাহাতে আলোক রয়।
কালি হইলো সেই শুভ্রতা
যে সদা সত্য কথা কয়।

কালি হইলো সেই সে প্রসাদ
যে শুধিতে পারে সকল ঋণ
রক্ত শুকায়, পুষ্প শুকায়,
কালি শুকায় না কোনোদিন।

কালি হইলো সেই শক্তি
যে করিতে পারে অসুর বধ,
কালির বুকে চরণ ফেলিয়া
চলের যায় কালের রথ।

কালির তেজে আলোক ছড়াইয়া
রোজ ঘটে সূর্যোদয়
কালির কোলে খুব চুপিসারে
ইতিহাস জেগে রয়।


কবি পরিচিতি

আফরোজা হীরা। জন্ম নভেম্বর ২২, ১৯৭৯ সালে। বাবা কাজী আবুল কাশেম এবং মা আমেনা বেগমের প্রথম সন্তান। ব্যক্তি জীবনে নানা রকম সেবামূলক কর্মকান্ডে তিনি জড়িত। এক কন্যা সন্তানের জননী হলেও নিজেকে হাজার সন্তানের মা বলে মাতৃত্বের পরিচয়ে গর্ববোধ করেন। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে মোংলা উপজেলা শাখার যুগ্ম আহবায়ক ও মোংলা পোর্ট পৌরসভার নগর উন্নয়ন প্রকল্প (TLCC) এর সদস্য হিসেবে সামাজিক উন্নয়নে দায়িত্ব পালন করছেন। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ইউ এন ডিসি এর মোংলা উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক পদে পথ-শিশুদের জন্য কাজও করেছেন।

পার্বতী পারু – এই ছদ্মনামে লেখালেখির জগতে তাঁর পদার্পণ। লেখার মধ্য দিয়ে মানবতার কথা বলা এবং সমাজের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এ যাবত উপন্যাস, একক ছোটগল্প, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ছড়া, কাব্যগ্রন্থ, এবং যৌথ কাব্যগ্রন্থ মিলিয়ে মোট বিশটি বই প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ এবং কোলকাতায়। লেখালেখির বাইরে বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের সাথেও সম্পৃক্ত তিনি। বর্তমানে সার্ভিস বাংলাদেশ এর নারী শিশু ও সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক এবং দুর্জয় বাংলা সাহিত্য গ্রুপের খুলনা বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া দখিন হাওয়া সাহিত্য পরিষদ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসাবে মোংলায় সাহিত্য চর্চার বিকাশ ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর – মোংলায় বইমেলার প্রথম আয়োজনও করেছেন নিজের প্রকাশিত বই দিয়ে নিজস্ব প্রচেষ্টায়।