ঠগবাজ
– সুবোধ চন্দ্র মন্ডল
আজ সমাজটা অনেক বদলে গিয়েছে। যখন থেকে এপ্রিল ফুল করার রেয়াজটা শুরু হয়েছিল, সেই সময়কার সমাজ আর এখনকার সমাজের মানুষের মানসিকতার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সেই সময় মানুষ একটা দিন শুধুই একটু মজা করার জন্য মানুষকে ঠকাতো। আর আজ? আজ প্রতিদিন. প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্তে মানুষ, মানুষকে ঠকিয়ে যাচ্ছে। সন্তান ঠকাচ্ছে বাবা-মাকে, আত্মীয়-স্বজন ঠকাচ্ছে তাঁর পরিজনদের। বিক্রেতা ঠকাচ্ছে ক্রেতাকে। ভালোবাসার সম্পর্কে প্রেমিক-প্রেমিকা ঠকাচ্ছে উভয়কে। রাজনৈতিক নেতা ঠকাচ্ছে দেশের মানুষকে। সমাজের যত রকম স্তরে ঢুকুন না কেন সেখানেই দেখতে পাবেন, এর প্রত্যেক স্তরের কেউ না কেউ কখনও না কখনও একে অন্যকে অবিরত ঠকিয়ে চলেছে। ঠকে যাওয়া মানুষটির আর্থিক ক্ষতি সহ তার হৃদয় চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায়।
এমনকি, লোক এখন এত ঠকাচ্ছে যে মানুষের জীবনও চলে যাচ্ছে ঠগবাজদের চক্রান্তে পড়ে। মানুষের প্রাণের দামের থেকে কি ঠগবাজদের লোভের দাম বেশি? নিজের লাভের জন্য নৈতিক শিক্ষাকে ঠকিয়ে অন্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারো নেই।
দেশটা, এমনকি-পৃথিবীটা আজ ঠগবাজদের পৃথিবী হয়ে গেছে। মানুষের করুণাকেও রেহাই দেয়নি ঠগবাজ মানুষেরা। ঢাকার ফুটপথ, বাসের ভিতর, ফুটওভার ব্রীজ ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় মাঝবয়সী নারীপুরুষ অঝোর নয়নধারায় কেঁদে-কেঁদে সাহায্যের জন্য জনে জনে আবেদন করে। এ দৃশ্য হরহামেশাই প্রতিদিন চোখে পড়ে। তেমনি একটা দিনে এরকম দৃশ্য দেখি –
একজন ভিক্ষুকটি বলছে তার বাবা মারা গেছেন, লাশ পড়ে আছে মেডিকেলের বারান্দায়। লাশ বাড়ি নিয়ে যেতে তার কিছু সাহায্যের দরকার। কিন্ত কেউ তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। এই দৃশ্য দেখে বিবেকের টানে আমি মুহূর্তেই একটা ১০ টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দিলাম। ১০০ টাকার নোট দিতে না পারায় খারাপ লাগছিলো। ভাবছিলাম বেশি টাকা দিলে হয়তবা লাশ নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারতো।
আমার টাকা দেয়ার এই ঘটনা দেখে এক পথচারী আমাকে ডাকলেন। আমার মুখের দিকে চেয়ে উনি বল্লেন – নতুন এসেছেন? পাশের একজন বলে উঠলেন – দিল এখনো নরম। ব্যাপার না, কিছুদিন গেলেই সব ঠিক অইয়া যাইবো।
আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ দেখে পাশের আর একজন বল্লেন – আপনি যারে টাকা দিছেন তার কেউ মরে নাই। সে মিছা কথা কইছে। এই সব বইলাই তারা ভিক্ষা করে।
এই কথা শুনে আমি এমন এক ধাক্কা খাইলাম যা মুখে কোন রা কাটেনি। আর মনে মনে ভাবছিলাম এ-ও কি বিশ্বাসযোগ্য?
এরপর বুড়িগঙ্গায় কত জল বয়ে গেলো। তারপর রাত-বিরেতে কাজে-অকাজে শহরের রাস্তায় কত পাক খাচ্ছি আর এই সব দৃশ্যগুলো খুব নিকট থেকে দেখছি। বাসের ভিতর দেখি গলায় একটা বেল্ট বেঁধে খোড়াতে খোড়াতে এসে জনে-জনে খয়রাতি চাচ্ছে। কেউ দিচ্ছে কেউ দিচ্ছে না। বাসের থেকে যখন নেমে যাচ্ছে তখন দেখি সেই একই লোক হনহনিয়ে হেঁটে ভিড়ের ভিতর মিলিয়ে যাচ্ছে। ঠগবাজি কারে কয়! দেখে বিষ্মিত হতে হয়।
এই ঠগবাজ প্রতারকদের কারণেই সত্যিকারের বিপদগ্রস্ত ও করুণাপ্রার্থী মানুষকেও আমরা সন্দেহের চোখে দেখি। ফলে একদিন মানুষের সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে। … … তখন এই ঔদাসীন্য হয়ে যাবে একটা অসুস্থ সমাজের লক্ষণ।
দিনে যে ভিখারী হাইকোর্টের মোড়ে হাতে ব্যন্ডেজ বেঁধে ভিক্ষা করে, রাত দশটার পর দেখি সেই আবার হাইকোর্টের সামনে ফুটপথে তার বিছানায় আধাশোয়া হয়ে ব্যন্ডেজ খুলছে। আর হাত পায়ের আড়মোড়া ভাঙছে। দিনে যে পঙ্গু রাতে সে দিব্যি দু-পায়ে হাঁটে। মানুষের সংবেদনশীলতাকেও এ ভাবে পুঁজি করে মানুষ?
এক কম-বয়সী নারীকে দেখতাম কোলে একটা শিশু নিয়ে একটা ফুটওভার ব্রীজে প্রতিদিন বিলাপ করে কাঁদে। খাবারের জন্য টাকা চায়। সত্যি কথা বলতে কি, ঐ বিলাপকারী কম-বয়সী নারী অন্য একজনের বাচ্চা ভাড়া করে এনে খাবারের জন্য টাকা চাচ্ছে। বিলাপকারীকে দেখে আমার মধ্যে কেমন যেন ক্ষোভের জন্ম হতো। মনে হতো মানুষকে ঠকাবার জন্য এদের পুলিশে দেয়া দরকার।
এই ঠগবাজ প্রতারকদের কারণেই সত্যিকারের বিপদগ্রস্ত ও করুণাপ্রার্থী মানুষকেও আমরা সন্দেহের চোখে দেখি। ফলে একদিন মানুষের সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে। চোখের সামনে দূর্ঘটনার শিকার হয়ে একটা মানুষ রাস্তায় পড়ে থাকলেও এগিয়ে না যাওয়া, এবং সন্ত্রাসীদের হাতে তাড়া খাওয়া একটা মানুষ বাঁচাও বাঁচাও বলে অন্যের সাহায্য চাইলেও সন্দিহান চোখে দেখবে আর সেই আক্রান্ত মানুষের ডাকেও সাড়া দিবে না। তখন এই ঔদাসীন্য হয়ে যাবে একটা অসুস্থ সমাজের লক্ষণ।
আজকাল ভিক্ষা হয়ে উঠেছে বিনা শ্রমে অর্থোপার্জনের উপায়। মানুষের সংবেদনশীলতাকে পুঁজি করে অন্ধ না হয়েও অন্ধ হবার ভান করে মানুষকে ঠকিয়ে টাকা কামানোর মানসিকতা আর প্রতারণা করে এবং দুর্নীতি করে বা ঘুষ নিয়ে বেশি টাকা উপার্জন করে সম্পদ বাড়ানোর মানসিকতাও একই সুত্রে গাঁথা।
পরিচিতি

সুবোধ চন্দ্র মন্ডল। জন্ম জানুয়ারী ১৫, ১৯৬৩, বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় হলদিবুনিয়া গ্রামে । বাবা স্বর্গীয় শ্রী অশ্বিনী কুমার মন্ডল এবং মাতা ঈশ্বর শ্রীমতি বিল্ল রানী মন্ডল। মোংলার সেন্ট পল্স উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে যথাক্রমে এস এস সি ও এইস এস সি পাশ করার পর খুলনা সিটি কলেজ থেকে ব্যচেলর অব সাইন্স এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওগ্রাফিতে মাস্টার অব সাইন্স অর্জন।
চাকরি জীবন কেটেছে এন জি ও সেক্টর এবং প্রাইভেট কোম্পানীতে। স্বেচ্ছায় অবসরের পর বর্তমানে ফরেক্স এবং ফ্রিল্যান্সিং-এ লিপ্ত। ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। স্ত্রীও একটি এন জি ও-তে চাকরি করছে এবং একমাত্র কন্যা সপ্তর্ষি মন্ডল অদিতি আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল ইনিস্টিটিউট থেকে ল্যবরেটরী সাইন্সে ডিপ্লমা শেষ করে এখন অনার্সে ভর্তি হবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ছেলেবেলা থেকে কবিতা পড়তে খুব ভালো লাগতো। তার লেখার অনুপ্রেরণা এই পড়া থেকেই। অনিয়মিত হলেও কখনো কখনো কবিতা বা গল্প লেখার চেষ্টা অভ্যাসগুলোর মধ্যে একটা। তবে নিজেকে কখন কবি বা গল্পকার হিসেবে দাবি করেন না – যা কিছু মন থেকে ভালো লাগে তাই লিখে ফেলেন ভালোমন্দ কিছু না ভেবেই।