মৃত্যুপথযাত্রী
– দেবপ্রসাদ কুশারী
আজ নিয়ে বনমালী তিনদিন হল উপোষ করে রয়েছে।
বনমালী দীনদয়ালের বাগানের মালি। দীনদয়াল সবেমাত্র একবছর হল গত হয়েছেন। তিনদিন আগে পর্যন্ত বাবুর বাগানের যত্নের তিলমাত্র ব্যত্যয় হয় নি। ফুলগাছ গুলো যেটা যেমনটি ছিল তেমনটি সেই শোভাই বর্ধন করে আসছিল।
বাবুর খুব প্রিয় ছিল ছোট্ট এই সবুজ লনটা। বাগান বাড়ির সামনের ছোট লনটার চার কোনের চারটি ঝাউগাছ। তার চারপাশ ঘিরে হরেক রকমের নানা রঙের ফুলগাছ। দূর থেকে দুহাত তুলে ঝাউগাছগুলো যেন সৃষ্টিকর্তাকে অভিবাদন জানান দিয়ে আসছিল। কিন্তু কি এমন হল তিনদিন আগে।
উপোষী শরীরে সে দিনের ঘটনাটি বনমালীর মনে পরতেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বুক খালি করে বেরিয়ে এল।
অন্যান্য দিনের মত বনমালী লনের ঘাসগুলো কাঁচি দিয়ে ছাঁটছিলো। বাবুর গাড়ির আওয়াজ কানে আসতেই বন তাড়াতাড়ি বড় ফটকটি খুলে দেয়।
বনমালী অভ্যাসবশতঃ হাতজোড় করে প্রনাম জানায়।
দীনদয়াল হাত তোলে। গাড়িটা বাঁদিকে বাঁক নেওয়ার সময় কোনের ঝাউগাছটার সামনে একটু দাঁড় করায়। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওটার গাঢ় সবুজ রঙের পাতাগুলোর গায়ে হাত বোলায়। বনমালীর উদ্দ্যেশে বলে,
-দেখ, দেখ, বনো কি রকম আদর খাচ্ছে।
বনমালী সেদিন লক্ষ্য করেছিল ঝাউগাছটার পাতা গুলো যেন কি এক অমোঘ টানে বাবুর দিকে নুয়ে পরেছে।
এই ছিল ওটার আদর খাওয়ার ছবি।
বাবু চলে যাবার পর থেকে যেটুকু আদর বনো নিজেই করে আসছিল।
বাবুর ছেলে প্রভুদয়াল এখন গাড়ি নিয়ে ঢোকে।
বৃদ্ধ বনমালী এখনও ফটক খুলে দেয়। সেই গাড়ি এখন ও
একটু গিয়ে বাঁদিকে বাঁক নেবার সময় ক্ষনিকের জন্য থামে। তবে সেটা কাউকে আদর করার জন্য নয়। বরং এক প্রকার বিরক্তিতে।
প্রভুর গাড়ি বাঁক নিতে অসুবিধা হয়।
আজ প্রভুদয়াল কি ভেবে বনোকে ডাকে
-বনমালীদা, এখানে আসেন তো।
বনমালী ত্রস্ত পদে কাছে আসে।
-শোনেন দাদা, এই গাছটাকে ঐখানে সরিয়ে দেন তো।
বলে রান্নাঘরের সামনে সামান্য একটু মাটি আছে জায়গাটা দেখায়।
বনমালী স্তম্ভিত। বলেন কি প্রভুদয়াল? এত বড় গাছটিকে উপড়ে তুলে অন্য জায়গায় পুঁতে দিলে বাঁচে নাকি?
প্রভু বনোর ইতস্ততঃ ভাব দেখে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একটি কথাই বলে যায়।
-পরশু দিনের মধ্যে কাজটা পুরোপুরি হয় যেন।
সেদিন ছিল রোববার। প্রভু জনা পাঁচেক লোক বনমালীর কাছে পাঠিয়ে দেয়। বনমালী দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা শাবল কোদাল গাঁইতি দিয়ে গাছটাকে মরা মানুষের মত হেঁচড়ে রান্নাঘরের সামনে বসিয়ে দিল। বনো ওর আগের জায়গায় সুবিশাল গর্তটার দিকে তাকায়। অনেক শিকড় এখনও এদিকে ওদিকে উঁকি মারছে। ওগুলো কাটা হাত পায়ের মত ওখানেই পড়ে রইলো।
গত তিনদিন ধরে গাছটি ধীরে ধীরে বিবর্ণ হতে শুরু করেছিল। আজ আর একটি পাতাও সবুজ রইলো না।
ধূসর রঙের শীর্ণ গাছটি যেন সত্যিই মৃত্যুপথযাত্রী।
বনমালীর আজ নিয়ে তিনদিন হল উপোষ চলছে।
লেখক পরিচিতি

দেবপ্রসাদ কুশারী। পেশায় Rubber technologist. বিশ বছরের কর্মস্থলকে বাই বাই করে উত্তরাখন্ডের হরিদ্বারে একটি স্কুলে পড়াতে পড়াতে শুরু হয় গান ও কবিতা লেখা। অত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে অজস্র লেখা লিখতে লিখতে তেরো বছর বাদ কোলকাতায় ফিরে আসি। শুরু হয় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রেরণায় গল্প লেখা। আধ্যাত্মিকতা আমার জীবনের পরম আর্শীবাদ। বর্তমানে পাণিহাটি সৎসঙ্গ মন্দিরের পূজারী। গঙ্গার পারে মন্দির। হরিদ্বারকে মনে করিয়ে দেয়।