শুক্লা বোস – কবিতাগুচ্ছ – ২

প্রকৃতির মেয়ে

– শুক্লা বোস

ওই দেখ চেয়ে চেয়ে—
নদী-তট-তীরে মাছ ধরিতেছে প্রকৃতির এক মেয়ে।
নামটি কী তার জরিনা সবিতা, কিছু রাখি নাই মনে,
শুধু জানি মনে ধরিতেছে মাছ মিশে প্রকৃতির সনে।
লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা বেণী দুটি দুলিতেছে কাঁধ বেয়ে,
আকাশ বুঝিরে লালে লাল হয় ওই লালফিতে চেয়ে।
নীল শাড়িটারে জড়ায়ে শরীরে কোমরে আঁচল গোঁজা,
চলিয়াছে দেখ কিশোরী তনুজা-মেঠো আল পথে সোজা।
নীলাকাশ বুঝি ধরে নীল রং নীল শাড়ি পানে চেয়ে,
শ্যামল-সবুজ-অবুঝ লালিমা ঝরিছে কপোল বেয়ে।
বাঁধনহারা বৃষ্টির ধারা ঝরিতেছে রয়ে রয়ে,
কিশোরী তনুর পরশ মাগিয়া ঝরিছে তনুটি বেয়ে।
নেট দিয়ে ছাওয়া তিন কোনা জালে ধরিছে চিংড়ি পোনা,
চরের উপরে রাখে সে হাড়িতে – তখনো হয়নি গোনা।
জল-কাদা-মাটি সারা গায়ে মাখি তুলিছে চিংড়ি ছেঁকে,
কিশোরী তনুটি যেন বাঁকা নদি-চলিয়াছে এঁকেবেঁকে।
হাসিভরা মুখে জলে আর চরে চলিতেছে ছুটে ছুটে,
শ্যাম-শ্যামলিমা সবুজের মায়া কোমল মুখেতে লোটে।
ঘোলা লোনা জল দ্রুত ছুটে চলে নদীর দুকূল বেয়ে,
ছুঁয়ে যায় তারে ব্যাকুল হরষে পরশের সুখ চেয়ে।
সখীরা তাহার ধরিতেছে মাছ ছড়ায়ে ছিটায়ে দূরে,
কখনো বা আসে কাছেতে সরিয়া কখনো বা যায় সরে।
এ উহার পানে তাকায়ে তাকায়ে হাসিতেছে খিলিখিলি,
কৌতুকে যেন হাসিছে তটিনী উহাদের সনে মিলি।
নেই কোলাহল, নেই যানজট নেই শহরের শব্দ,
শহরের ওই বদ্ধ বাতাস-এখানে হয়েছে জব্দ।
দূষণহীন এই মুক্ত বাতাসে গায়ে মেখে ঘোলা জল,
প্রকৃতি তনয়া খেলা করে যেন – মুখখানি ঢলঢল।
মাছ ধরা শেষ – নেটের জালটি গুটায়ে নিয়েছে ধীরে,
এক কাঁখে হাঁড়ি আর হাতে জাল, কিশোরী ফিরিছে ঘরে।
প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতির মেয়ে, মিলে প্রকৃতির সনে,
লীন হয়ে যেন মিশে আছে সে যে প্রকৃতির এক কোনে।
হোক না তাহার মলিন বরণ, থাকনা দুপায়ে কাদা,
প্রকৃতির মেয়ে প্রকৃতির কোলে – স্নেহডোরে আছে বাঁধা।

জাগো নারী

– শুক্লা বোস

আঁধারের পার হতে আলোক রেখা,
জাগো নারী, জেগে ওঠো বহ্নিশিখা।
বিধাতা তোমারে সাজায়ে দিয়েছে কত আভরণ দানি,
কখনো যে তুমি কোমলা কামিনী, কখনো ভয়ংকরী।
নিষ্ঠা-প্রেরণা, শিক্ষা-ধর্ম হোক তব আভরণ,
বাহ্যিক সব আভরণে সাজি নিজেরে কোরোনা ম্লান।
তুমি বীরজায়া, বীর প্রসবিনী তুমি যে গো বীরমাতা,
যুগে যুগে তাই ঘোষিছে ধরণী তোমার বিজয় বারতা।
মাতঙ্গিনী হাজরা যে তুমি – তুমি বীণাপানি দাস,
বিদেশী বেনিয়া বিতাড়নে তুমি রচিয়াছ ইতিহাস।
সেদিন দেখেছে ইংরেজ সেনা তোমার পরাক্রম,
মাতৃভূমিরে স্বাধীন করিতে তোমার রক্তদান।
তোমার মাঝেতে জাগে প্রীতিলতা, কনকলতা গো তুমি,
তব বীরত্বে রহিয়াছে ঋণী – তোমার জন্মভূমি।
তুমি যে গো মাতা – মাদার তেরেসা,বেগম রোকেয়া তুমি,
মানব সেবায় তব অবদান বারে বারে আজ স্মরি।
অজ্ঞানতার অন্ধ তিমিরে যখন ডুবিল নারী,
শিক্ষার দীপ জ্বালিলে আঁধারে, বেগম রোকেয়া তুমি।
সমাজের যত বাঁধা-বিঘ্নকে দুই পায়ে দলি দলি,
নারীরে দানিলে শিক্ষার আলো – বারে বারে তোমা নমি।
অনাথ-আতুরে বুকেতে বহিয়া মাদার তেরেসা নারী,
ভূমিতলে লিখি আখরের লেখা – দিলে বিদ্যার বাণী।
নাহি ছিল ধন, নাহি কোন জন – কোন সে শক্তিবলে,
জগৎ মাঝারে হইলে পুঁজিতা – এই ধরণীর তলে।
তোমার গর্ভে লভিয়া জনম, অবতার অবতারে,
মুক্তির পথ দেখালে মানবে পৃথিবীতে বারে বারে।
কয়াধু জঠরে জনম লভিল ভক্ত সে প্রহ্লাদ,
ভগবান দ্বেষী স্বামীরে ভজিয়া ভক্ত করিল দান।
অসুরদলনী দূর্গা যে তুমি – জ্বলে ওঠো নারী তেজে,
তব মহিমায় তুমি মহীয়ান – এই ধরণীর মাঝে।

সে

– শুক্লা বোস

বাবু!এবারে তাইলে আমি যাই?
সব কাজ সারা মোর – আর কোন কাজ বাকি লাই।
ঘর মোছা, থালা মাজা,
হাঁড়ি কুড়ি তাও মাজা,
ঘর-দোর সাফ করা
কোটা-কাটা তাও সারা,
কোন কাজ কিছু বাকি লাই।
তাকিয়ে পিছনে ফিরে
ভালোকরে দেখি তারে।
ঘন দুটি কালো আঁখি
সে আঁখিতে নেই চঞ্চলতা
অভাবের মসীলিপি আঁখি তটে আঁকা।
গভীর বিষন্ন মেঘ-মায়া –
ফেলেছে কাজল ছায়া দুটি চোখে।
তালি দেওয়া ছেঁড়া শাড়ি জড়ানো শরীরে,
উস্কো খুস্কো চুলগুলো ঝুটি করে বেঁধেছে উপরে।
শীর্ণ শরীর পরে অভাবের তপ্ত ছাপ লেখা।
“ঘরে কে কে আছে তোর?”
“কেউ লাই বাবু,
ছোটো এট্টা ভাই – আর কেউ লাই!
ছেলো মা টা মরি গেল আজান কোন জ্বরে –
আর কেউ লাই ঘরে পরে।
বাপ্ ছাড়ি চলি গেল কোথা কোন দ্যাশে –
কে জানে!
ভাইটারে লয়ে আছি হু-ই বস্তিতে –
এট্টা শুধু ছোটো ভাই
আর কেউ লাই!”
গভীর মাতৃত্ব যেন হঠাৎ চকিতে জেগে
হঠাৎ মিলায়ে গেল শীর্ণ মুখপরে।
“খেয়েছিস কিছু?”
এইবারে হাসলে সে সকরুণ হাসি।
সে হাসিতে নেই কোন চাওয়া,
নিষ্করুণ অভাবের গভীর বেদনা
ফুটে ওঠে অধরের পরে।
“লা-রে বাবু!
এঁটো কিছু ভাত ছেলো তোর থালা পাশে
সে কটারে বেঁধে নিয়ে লইছি আঁচলে।”
আঁচলটা উঁচু করে দেখালো আমারে।
“ঘরে যেয়ে ভাইটারে খাওয়াব এ-কটা
তারপরে ছুটে যাবো দত্তদের ঘরে।
খাওয়া দেয় ওরা মোরে দুপুরের কালে।
ডাল-ভাত তরকারি, আর মাছ ঝোল,
মাংসও দেয় কোন কালে।
থালে করে লয়ে আসি ঘরে,
ভাইটারে ফেলে একা খাবো কি করে?
সেই ভাত তরকারি ভাগ করে খাই –
দুই ভাই-বোনে।
প্যাট ভরে না – হয়ে যায় তবু।
ভাত রেঁধে খেয়ে লিস বাবু, – আমি তবে যাই!”
এই বলে দ্রুতপদে ছুটে গেল চলে।
মুখস্ত পদ্যের মত বলে গেল সব,
আমি ঘরে একা বসে নিস্তব্ধ নীরব!


কবি পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।

ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।

বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।