যোষেফ হাজরা – গল্প – আমি কেউ নই

আমি কেউ নই

– যোষেফ হাজরা

এটা ছিল সামান্য একটা দুর্ঘটনা, যার অজুহাতে অফিসের মেনেজারের কাছ থেকে পনের দিনের মত ছুটি নিয়ে ছিলাম। বলতে গেলে কিছুই হয় নি, বরং ছুটিতে সমুদ্র গিয়েছিলাম, গোপনে।

এর মধ্যে আমাদের অফিসে নতুন মেনেজার এল। আমি আগে থেকেই অবশ্য জানতাম। সমুদ্রে ছুটি কাটাবার সময় একদিন আমার কলিগ শফিউল ফোন করে বলল, মেনেজারটি নাকি মহিলা, অসম্ভব ইয়ে। মানে ওর মুখে কিছুই আটকায় না। আমি বহুদিন ওকে বারণ করেছি, সব জায়গা কী তোর সামাদের চায়ের দোকান।? আমার এই মাত্র পনের দিন ছুটি, শেষ হল মনে হয় দু’ঘন্টায়। বিশেষত সেই দুটি ঘন্টা, সে সময়টা আমি সমুদ্রের সাতার কেটেছি আর স্পিড বোটের করে ডলফিনের মাঝে যাওয়াটা ছিল অসম্ভব রকম মাইন্ড ব্লোইং।

যাই হোক ছুটি থেকে ফিরে এসে আমি আড়মোড়া দিতে দিতে অফিসে ঢুকলাম। অন্য কলিগেরা জিজ্ঞাসা করল, আমি কতটা সুস্থ। আর শফিউল সবই জানে, তাই খোটা মেরে বলল, ছুটি কেমন কাটল। উত্তর দেইনি, না দিয়েই ঢক ঢক করে ঢুকে গেলাম মেনেজারের ঘরে, পরিচয় পর্বটা আবশ্যক কিনা।

মেনেজারের ঘরে ঢোকা মাত্রই আমার মাথায় স্মরণকালের কঠিন বজ্রঘাত হল। আমার চাকরি থাকবে কিনা, সেটাও জানি না, যদি জানতাম, তবে রঙ্গ করে গল্প লিখতে বসতাম না। কারণ আমার সামনে যে মেনেজারটি বসে আছে, সে আর কেউ নয়, আমার পুরনো বান্ধবী, যাকে আমি আমার জীবনের সব কিছু দিতে চেয়েছিলাম, যার জন্য বিয়েটা পর্যন্ত করিনি, এমন কি প্রতিদিন অন্তত পক্ষে একবার, বেলকনিতে লাগানো বেলি ফুল গাছটার দিকে চেয়ে চেয়ে তার কথা ভাবি। সেই হঠাৎ এভাবে আমার মেনেজার? কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি, কিছু বলতে না পেরে ফিরে যাচ্ছিলাম।

বেলি তখন আমাকে ডাকল, আপনার নাম আবির, হ্যাঁ, বসুন।

কী নির্লিপ্ত, যেন কোন দিন আমাদের দেখাই হয় নি।

বেলি – আপনি এখন সুস্থ আছেন, আচ্ছা শুনুন, আমাদের কালেকশন গুলোতে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ, না না।
বেলি – আপনি কি একটু জল খাবেন?
হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, বেলি তুউউউউ…
বেলি – হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন, আমার নাম বেলি।
আমি – আপনার আর কিছু বলার না থাকলে, তাহলে আমি আসি।

আমার যেরূপ মানসিক অবস্থা তাতে সেদিন কাজে বেশ কয়েক বার ভুল হল। শফিউল আমার ভাবের পরিবর্তন বোঝে, কী ভাই আপনিও, আপনি না সন্ন্যাসী?
আমি – বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু শফি, ভাল হবে না।
দুপুরের লাঞ্চের সময় আমি, শফি, আনসার – আমরা তিন জনে যথারীতি চায়ের দোকানে। শফিউল জানতে চাইল, মেনেজার কিছু উল্টাপাল্টা বলেছে কিনা।
আমি – না না, হ্যাঁ বলেছেইতো …
শফিউল – কী বলেছে?
আমি – বলতে গিয়েছিল – যখন বললাম মটর সাইকেলে দূর্ঘটনা, বলল বিলটা পাঠিয়ে দেবেন, অফিস থেকে খরচ বহন করা হবে।

এরপর থেকে দিন যত যায় আমার আর বেলির সম্পর্ক তত তরল হতে থাকে। আমি অবশ্য তাকে কখন মেডাম বলিনি। অন্যেরা বলে অবশ্য। আমি বলতাম শুধু মেনেজার, তারপর মিসেস বেলি এবং যখন কেউ না থাকে তখন বেলির সাথে যোগ হয়ে যায় তুমি। এই বেলির বিয়ে হয় পারিবারিক জোরাজুরিতে, তখন আমাদের সম্পর্ক দহরম মহরম, এক আধ বয়সী লোকের সাথে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া একটি মেয়ে। বয়সটা কিছু নয়তো, পরিবার রাজি থাকলে নাবালিকাও সাবালিকা হয়, রাজি না থাকলে সাবালিকাও নাবালিকা হয়। বিয়ে হয়ে গেল যেদিন, সেদিন খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আমার হাতেও কিছু ছিল না। যেহেতু সে সাবালিকা আর আমি নাবালক, বিয়ের আইনে যেটা বলে আর কী।

সেই বেলি যে এত বছর পর বুড়ো চাচার মত রিটায়ার্ড স্বামী নিয়ে ফিরে আসবে ভাবিনি। ওর একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে আছে। ওই মেয়ের বয়সের একটু বেশি বয়সে বেলির বিয়ে হয়েছিল। একদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিল মেয়েটার সাথে, নাম বলল রুপা। তারপর নিজের বোরকা খুলে আমার সাথে কুশল বিনিময় করল, আঙ্কেল কেমন আছেন, বাড়িতে আসেন চা খেয়ে যান, যদিও যেটা ও আমার প্রতি দেখিয়েছিল, সেটা ও কারো সাথে মনে হয় করে না, আসলে বেলি তাকে বলেছিল আমার সাথে পরিচিত হতে কিন্তু কেন, সে কথা বেলি ছাড়া আর কেউ কি জানে?
বেলিকে একদিন বলেছিলাম, তোমার মেয়েটি খুব সুন্দর হয়েছে, তোমার মত একটা পরী।
বেলি বলেছিলো, মেয়ে কি শুধু আমার, তোমার নয়? ও একদম তোমার মত হয়েছে।
আসলে চেহারার আদল আমি খুব বুঝতে পারি না, কারণ চোখের দিকে তাকিয়েতো কথা বলি না, শুধুমাত্র বেলি আর সেই সুন্দরী পরীটা ছাড়া।

মরা গাছে হঠাৎ যেন পাতা বেরিয়েছে, ফুল ধরেছে। আসলে গাছটিও মৃত নয়, বনস্পতির ছায়াতে থাকতে থাকতে পাতা হলদে হয়ে গিয়েছিল, পাতা ঝরা এই তীব্র শীতেও সূর্যের আলোকে উজ্জ্বল হয়ে, বনস্পতিকে সে যেন জানান দিচ্ছে আমি এখনো বেঁচে আছি, শুধু বেড়ে ওঠার জায়গা ছিল না তাই বাড়িনি। কখনো কখনো আমার মনে পাপ বোধ জাগত, বিশেষত যেদিন থেকে ওর বিয়ে হয়ে গেল। তখন মনে হত যদি পাপ হয়, তবে সে পাপ বেলিকে ভালবেসেই করেছি। তবে সব কিছু জানার পরেও আমাদের এই সম্পর্কটা সবার মেনে নেওয়া উচিত ছিল। সারাজীবন যারা নিজের লাশ নিজেরা বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে, তাদের পবিত্র সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে পাপ করেছে এই সমাজ। আমরা চাইতাম আমাদের মেয়েকে নিয়ে আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে। হয়তো পারতাম, কিন্তু দাগী আসামি হয়ে যেতাম সকলের কাছে। এত বছর পরেও যে আমার সে আমারই আছে, “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে” শুধু “দেখতে আমি পাই নি”।

এই অফিসটাতে বহুদিন কাজ করছি তবুও প্রমোশন হবার নাম নেই। বেলি আসার পর আমার প্রমোশনটা হল। আমি ক্যাসিয়ার হয়ে বেলির রুমে বসি তখন। জীবনকে মনে হত হাওয়ার মত হালকা, ফুরফুরে। বেলিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই ব্যাপারে। বলল, আমি কী জানি, তোমার যোগ্যতা ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি তো জানি, আমার কাজ কেমন, আগের মেনেজার আমার পরে ক্ষিপ্ত ছিল। ক্যাসিয়ার হবার পরেও তখন অনেক কাজ বেলিই করে দিত, বেলির কাজ শেষ হলে আমি করি সিগনেচার, আমার কাজ শেষ হলে সুনামটা বেলির। অফিসটাকে মনে হত আরেকটা সংসার, আর সংক্ষিপ্ত কিছু প্রেম, যদি প্রেয়সী থাকে, না হলে সব কিছু মনে হয় চাপিয়ে দেওয়া বোঝা, মাস শেষে নিজের মাথা আর শ্রম বিক্রি করে কিছু নগদ অর্থ, আর কীই বা থাকতে পারে এখানে।

তখন অফিসে আগে আগেই যেতাম। শফিউল বলে-কী হে, তোমার কপালে লক্ষ্মী ফিরেছে বলে কি কাজ দেখানো হচ্ছে, এত আগে আগে আস যে।!
আমি বলি, আরে না না, ক্যাসিয়ার তো হও নি কখন, হিসাব না মেলে যদি- গাঁটের কড়ি ঢালো। মনে মনে ভাবি – লক্ষ্মীই বটে।

সেদিনও আগে আগেই এসেছিলাম, বেলিও। আমাদের মুহূর্ত ভালই কাটছিল। হঠাৎ পিয়ন এসে বলে গেল বেলির সাথে কে যেন দেখা করতে এসেছে। বেলি বললো, পাঠিয়ে দাও। যিনি এলো তিনি হলেন বেলির স্বামী, কাঁচা-পাকা চুলে টুপি মাথায়, দাঁড়ি রেখেছে বেশ খানিক, দেখলে মনে হয় বেহেস্তের টিকিট তার পকেটে আছে। আসলে এই নুরানি চেহারাটা তার আখের গুছাতে সাহায্য করেছিল, ব্যবসার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা। পরে জেনেছিলাম এসব, একটা চেক দরকার ছিল তার। না, না, আমার তখন একটুও হিংসা হয় নি। প্রথম দর্শনে বৃদ্ধের প্রতি করুণা হয়েছিল। মির্জা সাহেবের সাথে বেলি পরিচয় করিয়ে দিলে তাকে চায়ের অনুরোধ করলাম, যদিও তিনি না করে দিয়ে উল্টো তার বাড়িতেই আমাকে দাওয়াত দিয়ে গেলেন, আমি অবশ্য তাকে আশ্বস্ত করলাম।

এই সুযোগে বেলিদের বাড়িতে যাওয়া আসা শুরু করেছিলাম। বেলি যে ডাকে তেমন নয়, বেলির স্বামীর কখনও জমির মামলা, কখনও কনস্ট্রাকশনের কাজ, আবার কখনও নতুন নতুন ব্যবসার করার প্লান প্রোগ্রাম, আমাকে ব্যবসার শেয়ার দিত, আমিও পুরষ্কার হিসেবে গ্রহন করতাম, আর কী চাই। আমার তো বাবা কবেই মারা গেছে, ওনার সাথে বসলে মনে হত বুড়ো বাবার সাথে বসে সম্পত্তি দেখছি, ঘরে আছে সুন্দরী বউ আর আদুরে মেয়ে। আমি মনে মনে চাইতাম বুড়োটা যেন পটল তোলে। কিন্তু সেদিকে তার কোন নাম নেই। আবার আমাদের আলোচলায় কখনো কখনো মেয়েটা আসত এটা সেটা দিয়ে যেত খেতে। মাঝে মাঝে বায়নাও করত, আংকেল সিলেট যাব, ইনানি বিজটা নাকি খুব সুন্দর, আংকেল আপনি পাহাড়পুর দেখেছেন, মাঝে মাঝে যেতাম আর মাঝে মাঝে যেতাম না, যেতে না পারলে শপিং করে দিতাম, এতে মেয়েটা খুব রাগ করত বটে তবুও এটা সেটা বুঝিয়ে ঠান্ডা করে রাখতাম।

তখন শীত রাত, আমার ট্রাভেল করার নেশা তো ছিলই, রুপারও দেখি এই বিষয়ে উৎসাহের কমতি নেই, একেতো নাচনে বুড়ি, তার উপরে ঢাকের বাড়ি। মেয়েটার খুব পিড়াপিড়িতে ঠিক করলাম রাসে যাব, দুবলা। বিভিন্ন ট্রাভেল গ্রুপ আছে যারা প্যাকেজ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পর্যটকদের নিয়ে যায়, বিশেষত সুন্দর বন সংলগ্ন সমুদ্র দেখতে হলে গ্রুপের সাথে যেতেই হয়, প্রথমত নিরাপত্তা, দ্বিতীয়তা অর্থনৈতিক সাপোর্ট। আমাদেরটা ছিল টু-নাইট থ্রি-ডেজস্ এর একটা প্যাকেজ, ত্রিশ জন বহন সক্ষম একটা কার্গো ছিল সেটা, আমি দোতলায় সিংগল রুম পেয়েছিলাম, ওরা তিন জনে একরুমে। বেলি বা রুপার কথা কী আর বলব-ওরা এই বাদার বনেই থেকে যেতে চায়, শত হোক শহুরে ধুলোবালি আর দূষণ থেকে একেবারে প্রকৃতি মায়ের নৈসর্গিকতার মধ্যে বিলীন হতে কার না মন চায়। আমার আর মির্জা সাহেবের মনে তখন বদ মতলব ঘোরাঘুরি করছে, সমুদ্রে একটু এলাহী আয়োজন যা সকলেই একটু কম বেশি করে থাকে, আমরা নিমিত্ত মাত্র, যা করাবার তা করে সময়ের গতানুগতিক ধারা। ঘড়িতে যখন রাত দুটো আমরা ছোট ট্রলারের করে বনে ঢুকলাম, সাথে কিছু এটা-সেটার বোতল। চাঁদনি রাত, আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল ট্রলার মালিক। তিন জন তখন বলতে গেলে বেসামাল, শুধু আধ গিরে একটা ছোকরা ছিল, খাইনি, তাই ওকে একটুখানি রুমেই চালান করে দিয়েছিলাম।

শীতের রাতে কত কী হয় জঙ্গলে, ওই হরিণের ডাক শোনা যায়, ওই কোথা থেকে বুনো শুয়োর গদগদ করে দৌড় মারল, আবার অন্যদিকে পুণ্যার্থীদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। ধুপ করে জলে কী যেন একটা পড়ল, নাকি পাখি ডানা ঝাপটানো শব্দ। আমি বললাম চল এবার ফেরা যাক। একটু সামনে যেতে না যেতেই শুনি জলের মধ্য হাপুস হাপুস শব্দ। এই নদীতে কুমির আছে বলেছিল, শিকার ধরেছে নিশ্চয়, আরে মির্জা সাহেব কোথায়, নৌকা ফিরাও, আরেকটু সামনে, এইতো, ট্রলার মালিকটা একপাশে ঝিমুচ্ছে, আমি লাফ দিলাম, উহ্ কী ঠান্ডা জল, কোন রকমে তাকে ধরলাম, আহ্! ডুবিয়ে মারবে দেখছি, ট্রলার কাছে এলে এক হাতে ট্রলার আরেক হাতে মির্জা সাহেবকে ধরে আছি, আপনি নৌকাটা ধরুন, এই এই উনাকে টেনে তোল, আরে মশাই পড়লেন কী করে, তখন বলেছিলাম মাল খেয়ে অত কাছে বসবেন না। ঠান্ডায় দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে দুজনের, ওনার কোট খুলে গা মোছা হল, তাকে ছেলেটার জ্যাকেট দিলাম। শীঘ্র চালাও, রুমে যথেষ্ট লেপ কম্বল আছে, দরকার হলে ফায়ার প্লেসের ব্যবস্থা করা যাবে। হল তাই, টিনের কড়াইতে আগুন জ্বালানো হল কিছুক্ষণ, বেলি আর রুপা আমার আর ওনার হাতে পায়ে যথেষ্ট তেল মালিশ করে দিল।

বাকী যাত্রীরা এই ব্যাপারে তেমন কিছু জানল না, কোস্ট গার্ডকে মির্জা সাহেব নিজে একটু একটু সামাল দিল, টাকা খাওয়াল কিনা জানি না। কিন্তু তার পরের দিন ওরা কেউ রুম থেকে বের হলনা তেমন একটা। আমার ইনফ্লুয়েঞ্জাতে ধরল, তবুও বিচটাতে গেলাম, অসংখ্য ছবি তুললাম, সেলফি তুললাম। দুবলার যথেষ্ট সৌন্দর্য উপভোগ করে, এলাহি খাবার-দাবার ধ্বংস করে পরের দিন অবশ্য আমরা ফিরতি পথ ধরি।

অফিসে দুদিন পরে মেনেজার সাহেব এল, মুখ গোমড়া।
আমি – কেমন আছেন আপনার স্বামী, জ্বর কী একটু কমেছে?
বেলি – হুমমম্।

বোঝা গেল মন ভাল নেই ওর। সারা সকালটা এই বিষয়ে আর তেমন কথা হল না আমাদের, যেন ভীষণ কড়া কোন মেনেজার সে, অন্তত আমার সাথে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আমরা সারাদিনের হিসাবটা ক্লোজ করব, লোকজন ফাঁকাই বলতে হবে।

বেলি – মেরেই যখন ফেলতে চেয়েছিলে তখন বাঁচালে কেনো?
আমি – এটা মোটেও করতে চাইনি, তুমি এই ধারণা পোষণ কর আমার সম্পর্কে।
বেলি – জানি জানি, উনি বলল ওই সব ছাইপাশ খেয়ে তার গা গরম হয়ে গিয়েছিল, নিজেই নাকি নামলেন, পরে ঠান্ডায় হাত পা অবশ হয়ে মরতে চলেছিল। ওসব কেন খাও, আমাকে পেয়েও তোমার বিরহ কি এখনো কাটেনি?
আমি – তোমার কী মনে হয় উনার মত ঘাটের মড়াকে আমি এগুলো খাওয়াতে যাবো? উনি তো নিজেই আনলেন এগুলো। ওর মত একজন মদ্যপ লোকের সাথে এক সাথে উঠা বসা করি শুধু কার জন্য তুমি জান না?
বেলি – জানি বলেই বলছি, নিজেকে নিয়ে খেলা করো না। তারপর বেলি আমাকে চুমু খেল, বিয়ের পর এই প্রথম।

এই ঘটনার বছর দুই পর মির্জা সাহেব মারা গেলেন, আমার অনেক দিনের ইচ্ছা পূর্ণ হল। বেলী ফোন করলে গিয়েছিলাম এক বার, অনেক আত্মীয় স্বজনেরা এসেছিল শেষ কৃত্যে, অফিসের কলিগও ছিল তাদের মধ্যে। বেলি কাঁদছে, রুপা কাঁদছে, আব্বা আব্বা বলতে বলতে সে মূর্ছা গেল।

আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবছি হয়তো আমার অভীষ্ট পূর্ণ হল, হয়তো না, হয়তো আমি তাদের কেউ নই। ওদের চোখে জল বলে দিয়েছিল তুমি এদের কেউ নও, কেউ নও, তুমি দুরে চলে যাও, বহুদূরে যেখানে তুমি থাকলে সভ্য হত নাগরিক মানুষ। এত কিছুর পরে বেলি হয়তো কখনওই আমার ছিল না, এত বছর পরেও কি স্বামী হিসেবে বরণ সে আমাকে মেনে নিতে পারবে? সমাজ চুলায় যাক, তবুও নিজের কাছে নিজেকে আজ খুব ছোট মনে হচ্ছে। হয়তো আমার চাওয়ায় যুক্তি ছিল, কিন্তু মুক্তি ছিল না সর্বভুক মোহের।

কবি পরিচিতি

যোষেফ হাজরা। ছদ্ম নাম তারুণ্যের কবি।

আমি আমার জীবন গঠনের সময় বহু জায়গার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম। শহরের হাওয়া বা মফসলের জীবন এমনকি উত্তর আর দক্ষিণাঞ্চলের জীবনধারার ছোঁয়া আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি। আমার জন্মস্থান মোংলার স্বনামধন্য সেন্ট পলস হাসপাতালে। ১লা মে জন্ম হাওয়ায় ফাদার মারিনো রিগন আমার নাম যোষেফ (আধুনিকায়নে যোসেফ) রাখে। পিতা তাপস হাজরা, মাতা এন্ড্রো রিনা নাথ।

আমি প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমাদের ছোট নদী” কবিতা পড়ে তার সম্পর্কে জানি তখন থেকেই তিনি আমার অনুপ্রেরণা। এ জন্য চিত্রকলা, সংগীত, আবৃত্তি, অভিনয় ও পরবর্তীতে সেন্ট পলস স্কুলের লাইব্রেরি ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অপার সুযোগে লেখালেখির হাতে খড়ি দেই। সকল শিল্প-সংস্কৃতি থেকে আমি লেখালেখি করতে বেশি ভালবাসি। কারণ মনের কথা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করে, ভাষার জাদুকারিত্বে, জ্ঞান ও দর্শনের যে সমন্বয় হয়, সেই আত্মদর্শনে সম্পূর্ণ আত্মতৃপ্ত করতে সক্ষম। আমি যদিও রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব মানি তবুও তার ধাঁচে আমি লিখি না। আমি কাব্য ও রচনায় অন্যান্য ঢং রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করি যাতে কেউ পড়ামাত্রই বুঝতে পারে এই লেখনীর স্রষ্টা কেবলমাত্র আমি।