আবাস
– হিমেল বরকত
একান্নবর্তী পরিবার নিয়ে দুঃখ বের হয়েছিলেন নৌ-ভ্রমণে।
দাঁড় টানতে-টানতে বিষাদ নামের যুবকটি
কানে গুঁজে রাখা আলস্যে ঠোঁট ছোঁয়াবার প্রস্তুতি নিতেই
বেদনা নাম যে-মেয়েটির, খুব স্পষ্ট স্বরে ব’লে উঠল :
উঁহু, এখন ওসব চলবে না– জোরে চলো, জোরে…
কষ্ট খুক্ খুক্ কোরে কেশে নিয়ে পরিবেশটা পরিষ্কার করলেন।
অকস্মাৎ, হতাশা নামের ছোট্ট মেয়েটি কেঁদে উঠল আর্তস্বরে
এক বাটি চোখের জল এনে তার সামনে রাখলেন বিষণ্নতা।
সত্যি, তাদের সবারই খুব তাড়া– ঘরে ফিরতে হবে।
মানুষের বুক ছাড়া ওরা সর্বত্রই বড় শ্বাসকষ্টে ভোগে…
চোখ
– হিমেল বরকত
সব কিছুর পর
একজোড়া চোখই থাকে– দেবার মতো।
হাতের কথা যখন বললে, আমি কিন্তু এখনো
নখের বিষয়ে অতোটা আশ্বস্ত নই।
আর যদি ওষ্ঠের কথা বলো– সবচে’ খুশি হতাম
যদি দুই সারি দাঁত তার মেরুদণ্ড না-হতো।
তাহলে পা!
আহা, পালাবার মুহূর্তে পা-ই যে প্রথম দৌড়ায়…
তাই বলছিলাম, চোখদুটো যত্নে রেখো ।
দিনে অন্তত একবার কাঁদতে পারলে
চোখে অতো ময়লা জমে না।
আবহাওয়া সংবাদ
– হিমেল বরকত
খুঁজতে খুঁজতে আমি যখন নদীর কাছে পৌঁছুলাম, তখন তুমি দেবদারু গাছ। যুগল ডানা-সমেত ঝুঁকে প’ড়ে তোমাকে উষ্ণতা দিচ্ছে রোদের পাখিরা। আমি পিপাসার ওপার থেকে তুলে নিয়ে এলাম বুনো মেঘের খনি। তুমি ডালপালা নেড়ে বুঝিয়ে দিলে– এখন আর্দ্রতা জরুরি নয়।
আমার সর্বস্ব তখন মুদ্রায় পরিণত কোরে কিনে নিলাম মাতাল রোদ্দুর। আর তা-ই নিয়ে, যখন পুনরায় তোমার কাছে পৌঁছুলাম– তুমি তখন স্বপ্নের ডাকনাম ভুলে গেছো। তুমি তখন পাথরের নৈঃশব্দ্য বুকে এক পিপাসার্ত পোড়া কাঠ।
হায়! শীত ও গ্রীষ্মের পার্থক্য আমার আর কোনোদিনই শেখা হলো না…
মুখোশ দিবস
– হিমেল বরকত
শেষাবধি, অনেক দিবসই তো নির্ধারিত হল, সাড়ম্বরে উদযাপিতও হচ্ছে যথারীতি। বাবা দিবস, মা দিবস হতে শুরু করে ভালোবাসার বাণিজ্যিক ভুবন ডিঙিয়ে ছড়ি-তামাক-কিডনি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে উদযাপনের আঙুল। তিনশো পয়ষট্টি দিনের চোয়ালে দু-তিনটি আক্কেল দিবস ফোটার জায়গা ছাড়া সর্বস্থানই পরিপূর্ণ আজ।
আহা, দিবস উদ্যাপনে আমরা প্রতিনিয়ত কী অসাধারণ বিবেচনার পরিচয় রেখে চলেছি! বয়স্কদের রাজত্বে শিশু দিবস, পুরুষের সাম্রাজ্যে নারী দিবস, ধনীদের রাজ্যপাটে শ্রমিক দিবস– কী ঔদার্য আমাদের!
তবু, একটি দিবসের শূন্যতায় বহুদিন থেকে বড় হাঁসফাঁস লাগছে। ভেবে দেখুন, আমাদের প্রত্যেকের কাছে এতো প্রয়োজনীয় এবং অনিবার্য যে-মুখোশ, তার জন্য আজো একটি দিবস বরাদ্দ করা হলো না। আজো তার প্রাপ্য সম্মাননা দেওয়া গেল না। আসুন, আমরা একযোগে জাতিসংঘ বরাবর আবেদনপত্র প্রেরণ করি : মুখোশ দিবস চাই।
বছরের ঐ একটি মাত্র দিনও যদি মুখোশ ছাড়া থাকা যেত!
বিপণন
– হিমেল বরকত
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
বুদ্ধিজীবীর রক্তে-স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ
— রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
বাজার মাতাল করে নেমেছে ঢল…
ক্রেতা ও বিক্রেতা একই লোক, বহু লোক–
হাত বিক্রি করে কেউ কিনছে হাতিয়ার
মাথা বিক্রি করে কেউ কিনছে মুকুট
বিশ্বাস বিক্রি করে কুকুরের জিভ পেতে আছে কেউ-কেউ
কিনবে বন্ধুত্ব!
আমার তো নেই কিছু– কায়া নেই, ছায়া নেই…
বাউল হাওয়ার মতো শুধু ঘুরে-ঘুরে দেখি–
কার কতো লাভ হলো বেচা ও কেনায়!
কবি পরিচিতি

হিমেল বরকত। জন্ম অক্টোবর ১, ১৯৭৮ সালে বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার অন্তর্গত মিঠেখালি গ্রামে। পিতা মরহুম ডাঃ শেখ ওয়ালীউল্লাহ এবং মাতা মরহুম শিরিয়া বেগম। সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি এবং নটরডেম কলেজ থেক এইচ এস সি সম্পূর্ণ করার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ও সাহিত্যে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পি এইচ ডি ডিগ্রী অর্জন। পেশাগত জীবনে ঢাকা সিটি কলেজ, নর্থ সাউটথ ইউনিভার্সিটি এবং ২০০৬ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত।
বড়ভাই রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রেরণায় তাঁর সাহিত্য চেতনার বিকাশ ঘটলেও বাংলা সাহিত্য ও গবেষণায় নিজস্বতার প্রকাশ রয়েছে তাঁর লেখায়। তাঁর প্রকাশিত বই সমূহের মধ্যে কাব্য ও সংগীতগ্রন্থ – চোখে ও চৌদিকে, বৈশ্যবিদ্যালয়, দশমাতৃক দৃশ্যাবলি ও গানের ঝরা পাতা এবং প্রবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থ – প্রান্তস্বরঃ ব্রাত্যভাবনা ও সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচনাবলী (দুই খন্ড),কবিতা সমগ্র ত্রিদিব দস্তিদার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কবিতা, কবিতাসমগ্র রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, বাংলাদেশের আদিবাসী কাব্যসংগ্রহ প্রভৃতি গ্রন্থাবলী। বহ্নি,সাত্ত্বিক,হৃদ্য রৌদ্র ইত্যাদি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে তাঁর সম্পাদনায়। ভাষা ও সাহিত্যের উপর তাঁর বেশকিছু মৌলিক গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকায়।