দীপক রায় – আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ১১

আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ১১

– দীপক রায়

শ্রী নীরোদ বিহারী পোদ্দার। আমাদের এলাকার ইংরেজী সাহিত্যের এক অতুলনীয় শিক্ষকের নাম। শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ৭ম শ্রেণীর ছাত্র হিসাবে আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর ক্লাস পাওয়ার। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে আমাদের তিনি ইংরেজী দ্বিতীয় পত্র পড়াতে শুরু করেন। এটাই ছিলো আমার তাঁর প্রথম ক্লাস পাওয়া। তিনি কোন বই অনুসরণ করতেন না। শুধু জিজ্ঞাসা করতেন, আজ কী পড়াবো তোমাদের। আমরা বিষয়টা বলতাম। তিনি বৃহৎ (১০০জন ছাত্র ধারণক্ষমতাসম্পন্ন) ক্লাসরুমের উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বিত পাকা দেয়ালের সাথে তৈরি ব্লাকবোর্ডের সামনের প্রশস্ত জায়গাটুকুতে হাঁটতে হাঁটতে মুখে মুখে বিষয়টা পড়াতে শুরু করতেন। আমার মনে আছে তিনি বইয়ে নেই এমন সব রচনা ও চিঠি বা আবেদন পত্র শিখতে বলতেন; আর আমরা তা বোর্ডে লিখে দিতে বললে ধীরস্থির ভাবে লেখা শুরু করতেন। ওনার লেখা রচনা ও চিঠিগুলো বইয়ের লেখার চেয়ে ছোট হতো। আমরা মহা আনন্দে সেগুলো শিখতাম। মজার ব্যাপার হলো তাঁর লেখা চিঠি বা আবেদন পত্রগুলো কোনো রকম ভনিতা ছাড়া হঠাৎ আরম্ভ করে কয়েক লাইনেই শেষ হতো। যা অনেকটা আমেরিকান স্টাইলের মতো ছিলো।

মনে পড়ে ক্লাস সেভেনে বার্ষিক পরীক্ষায় ইংরেজী ২য় পত্রে অনেক কিছুই কমন না আসায় আমরা পরীক্ষার হলে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। বিশেষ করে চিঠি ও রচনা। আমরা জানতাম অন্য কোন স্যার প্রশ্ন করবেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে নীরোদ বাবু সময় পাবেন না। কিন্তু তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছিলেন আর তা ছিলো স্যারের মতই ভিন্ন রকম। হাতে লিখে তা সাইক্লোস্টাইলে কপি করা হয়েছিলো। পরীক্ষায় essay ও letter কমন না পড়াতে বেশ চিন্তায় ছিলাম – কারণ নিজের মত করে বানিয়ে লিখেছিলাম। তবে মার্কশীট পাওয়ার পর খুশী হয়েছিলাম। ভালো নম্বর পেয়েছিলাম। মূলত: এর পর থেকে ইংরেজী বিষয়টা বানিয়ে লেখা শুরু করি আর তা কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি চালিয়ে নিয়েছি। নীরোদ বাবু ইংরেজী বিষয়ের এক অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। আমরা ‘৭৭ এর SSC পরীক্ষার্থী হিসাবে ওনাকে ইংরেজীর শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম শেষের দিকে। আমরা এই সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে প্রায় প্রতি ক্লাসেই বিশেষ বিশেষ প্রশ্নের উত্তর স্যারকে দিয়ে লিখিয়ে রেখেছিলাম। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাবে বিশাল ব্লাকবোর্ডের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উত্তর প্রান্তে এক মনে তাৎক্ষণিক ভাবে লিখে দিতেন। না বলতেন না কখনও।

আজ তিনি এ পৃথিবীতে নেই। প্রতিবারই মোংলায় গিয়ে ওনার সাথে দেখা করার কথা অনেক ভেবেছি। তা আর হয়ে ওঠে নি। উনি সেন্ট পলস ছেড়ে গিয়েছিলেন। জেনেছিলাম স্থানীয় অন্য একটা স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন।স্কুলে বেশ কয়েক বার বেড়াতে গেলেও উনি না থাকাতে আর দেখা হয় নি। কোনো দিন গ্রামে যাওয়া আসার পথে দেখাও হয় নি আগের মতো। দেখা হলে তিনি আগেই কথা বলতেন নীচু স্বরে; যা তিনি চিরকাল করে গিয়েছেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম আমি আমার অন্য এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কাছ থেকে এক সকালে। তাঁর আত্মার চির শান্তির জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা জানাই।

সেন্ট পলস হাই স্কুলের মেধাবী শিক্ষকদের মধ্যে স্বর্গীয় শ্রী শশধর মল্লিক ছিলেন উল্লেখযোগ্য একজন। স্বল্পভাষী, ধীরস্থির নিচুগলায় কথা বলতেন তিনি – ক্লাসেও তেমনই। পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তাঁর নীরব রসবোধ আমাদের আকৃষ্ট করতো। তার পোষাক ছিলো সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। একদিকে ঈষৎ ঘাড় বাঁকিয়ে সব সময় ক্লাসময় হেঁটে হেঁটে পাঠ দান করতেন। যারা তার কথা শুনতো, তারা বিষয়টা তখনই বুঝে নিতো। যারা ক্লাসে কথা বলে বা দুষ্টামি করে ডিসটার্ব করতো, তাদের তিনি ছাড় দিতেন না। ধীর গতিতে তার দিকে এগিয়ে আসতেন, তার মাথা নিচের দিকে চেপে ধরে প্রচন্ড ভাবে, প্রচন্ড শব্দে তার পিঠের উপর বসিয়ে দিতেন তাঁর শক্ত থাবা, অন্তত: দু’বার। এ মারের কথা আজ মনে পড়লে ভয় লাগে, কারণ এতো জোরে মারতেন যে ভুক্তভুগীর মেরুদন্ডের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা হতে পারতো। তিনি মূলতঃ আমাদের বাংলা ব্যাকরণ আর ৭ম শ্রেণীতে সংস্কৃত পড়াতেন। বার্ষিক পরীক্ষায় সংস্কৃত বিষয়ে সব প্রশ্নের উত্তর সংস্কৃতে লিখে তাঁকে খানিকটা অবাক করে দিয়েছিলাম। তবে তিনি পরীক্ষায় মার্কস দিতেন খুব মেপে।

শশধর বাবুর অন্য দু’টি গুণ ছিলো গান গাওয়া আর অভিনয়। স্কুলের অভিভাবক দিবসে হতো নাটক; আর তিনি তাতে অভিনয় করতেন। তাঁর গাওয়া একটা বিশেষ গান আজও আমার প্রাণে বাজে: “তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে…।” তাঁর মুত্যুটা ছিলো বড়ই দুঃখজনক। তাঁর বয়স এমন কিছু ছিলনা যে তিনি মারা যাবেন। তিনি স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলেন এবং একটা পর্যায়ে স্মৃতি শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিক থেকে তিনি আমার মাসতুতো দাদা হতেন। আমাদের মামা বাড়ীতে তাঁর দাদু আর আমার দাদু আপন দু’ভাই ছিলেন। আমি তাঁর অসুস্থতার কথা শুনে যখন প্রথম বার তাঁকে মোংলায় দেখতে যাই, তিনি আমাকে চিনতে পেরে আমার সাথে বিছানায় বসে আকার ইঙ্গিতে কথা বলেছিলেন। দ্বিতীয় বার শুধু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। ঢাকায় ফেরার কিছুদিন পর তাঁর মৃত্যুর খবর পাই। তাঁর আত্মার চির শান্তি হোক!

জনাব এম. এ. মান্নান। আমাদের সময় সেন্ট পলস্ হাই স্কুলের একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, পোশাক-আশাকে কেতা দুরস্ত ছাত্রপ্রিয় শিক্ষক। সুদর্শন এই শিক্ষকের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতাম। তাঁর হাঁটা-চলা, কথা বলরা সব কিছুর মধ্যে একটা পরিচ্ছন্ন ভাব ছিলো। তিনি ক্লাশের পুরোটা সময় জমিয়ে রাখতেন। ফর্সা লম্বা শরীরে মানান সই পশ্চিমা পোশাকে তাঁকে দারুণ মানাতো। আমি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ষষ্ঠ শ্রেণীতে ইংরেজীর শিক্ষক হিসাবে মান্নান সাহেব কে পাই। সত্যি কথা বলতে, ক্লাসের পুরো সময়টা আমি দারুণ উপভোগ করতাম। তিনি ইংরেজী উচ্চারণের দিকে বিশেষ মনযোগ দিতেন এবং ক্লাসে আমাদের দিয়ে সব সময় ইংরেজীতে কথা বলাতে চেষ্টা করতেন। যে বিষয়টাতে এদেশের স্কুল কলেজে তেমন মনযোগ দেয়া হয় না বললেই চলে। তিনি প্রতিদিনই ক্লাসে ইংরেজীতে প্রশ্ন করতেন পাঠ্য বই থেকে। আমাদের ইংরেজীতেই উত্তর বলতে হতো। তিনি একটা প্রশ্ন করতেন একজন একজন করে। সঠিক উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত প্রশ্নটি চালিয়ে যেতেন। অন্তত: ৪/৫ জনের পর উত্তর ঠিক না হলে হঠাৎ একটু থেমে বলতেন – কে পারে? কেউ পারলে আমাদের হাত তুলতে হতো। আমি বেশ খানিকটা লাজুক ছিলাম, আর পোশাক-আশাকে ছিলাম আন-স্মার্ট (অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে)। জানি না কেনো, তিনি প্রায়ই শেষে আমাকে উদ্দেশ্য করে (আমার মনে হতো) বলতেন কে পারে? আমি হাত তুলতাম। এভাবে স্যারের সাথে আমার এক রকম সম্পর্ক তৈরি হয়। পরবর্তীতে তা বেশ কাছের হয় বলে আমার ধারণা জন্মে। ক্লাসে অমিয় নামে আমাদের এক বন্ধু ছিলো। দুষ্টুর শিরোমণি। অভিনয়েও পাকা ছিলো। সে স্যারের দেয়া বিভিন্ন পরিস্থিতির একক অভিনয় করে দেখাতো। তার মধ্যে একটা ছিলো আয়না ছাড়া লম্বা দাড়িওয়ালা কোনো লোক কীভাবে তার প্রায় সব কালো দাড়ির ভিতর থেকে চোখ বন্ধ করে আঙ্গুল চালিয়ে দু’-এক গাছি সাদা দাড়ি টান দিয়ে তুলে তা চোখের সামনে এনে সাদা হিসাবে নিশ্চিত হয়ে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়। অমিয় সুন্দর ভাবে তা দেখাতে পারতো! এমন আরও কতো কিছু! স্যার ওকে খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু পড়া না পারলে মাফ ছিলো না। তিনি পড়া না করা দু’জন ছাত্রের মধ্যেই তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। একদিন অমিয়র সাথে এক নিরীহ ছেলের শাস্তির ব্যবস্থা হয়। স্যার অমিয়কে বললেন ছেলেটির দু’কান ধরে তাকে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসিয়ে দিতে। অমিয় তার কান ধরে অনেকক্ষণ টেনে তাকে বসিয়ে দিলো। ছেলেটি কষ্টে কেঁদে দিলো। এবার ছেলেটির পালা। সে অমিয়র দু’কান ধরতেই অমিয় বসে পড়লো। শাস্তি আর তার হলো না, বুদ্ধির জোরে সে বেঁচে গেলো। স্যারের হাসি দেখে কে!

স্কুল ছাড়ার পর স্যারের সাথে আমার বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে। ঢাকায় অন্তত: দু’বার – একবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিকালে বেড়াতে গিয়ে, অন্যবার ঢাকা থেকে একই বাসে মোংলায় যাওয়ার পথে। সেদিন আমাদের সাথে ছিলেন অশোক বাবুও, আর আমার ছেলে সুদীপ্ত। সে তখন ৪/৫ বছরের। সারা পথ আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না তা মান্নান সাহেব বার বার জিজ্ঞাসা করছিলেন। অনেকটা সময় সুদীপ্তকে সামনের দিকের সীটে নিজের কাছেও রেখেছিলেন। এর পর স্যারকে দেখেছিলাম স্কুলের অনেক কাল পর সাদা চুলে স্কুলের ৫০ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে। আজ তিনি কেমন আছেন জানি না। ভাবছি একদিন শেলাবুনিয়ার বাড়ীতে গিয়ে ওনার সঙ্গে দেখা করে আসবো, আর তার সাথে কিছু স্মৃতিচারণও।

বাবু অমরেন্দ্র নাথ মন্ডল। শিক্ষক হিসাবে মোংলা অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলে কাজ করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজের এলাকায় অবস্থিত সেন্ট পলস হাই স্কুলে যোগদান করেন। আমি তাকে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছি যতদূর মনে পড়ে অষ্টম শ্রেণী থেকে দশম শ্রণী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের চৌকষ শিক্ষক হিসাবে। ব্যক্তি জীবনে তিনি আপাত দৃষ্টিতে গম্ভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সর্বোপরি অসম্ভব রসবোধের একজন প্রচন্ড রসিক মানুষ ছিলেন। শিক্ষকতা ছাড়া একজন দক্ষ অভিনেতা হিসাবে তাঁর তুলনা ছিলো না। একজন সুদর্শন মানুষ, লম্বাদেহী, আকর্ষণীয় কন্ঠের অধিকারী যাঁকে প্রাত্যহিক জীবনেও নায়ক বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। তিনি একজন সু-অভিনেতা হিসাবে বরাবর নায়ক চরিত্রেই অভিনয় করতেন। স্কুলের সব নাটকেই তিনি নায়কের চরিত্রটি করতেন। ৪০/৪৫ বছর বয়েসেও অদ্ভূত তারুণ্যের ছটায় আর আকর্ষণীয় অভিনয়ে তিনি সবাইকে চমকিত করতেন। একবার তো স্কুলের নাটকে তিনি তাঁর দশম শ্রণীতে পড়ুয়া কন্যার বিপরীতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাঁর শিক্ষা দেয়ার কৌশলটা ছিলো অন্যরকম। পড়াতে পড়াতে তিনি গল্পের গভীরে চলে যেতেন, সেখান থেকে ফিরে আসতেন হালকা হাস্যরস নিয়ে। আর এর কারণে আমরা সমস্ত পাঠটিকে মনে রাখতে পারতাম খুব সহজে। অপেক্ষাকৃত অমনোযোগী ছেলেরাও তাঁর পড়ানো বিষয়ের খুঁটিনাটি ঘটনা মনে রাখতে পারতো।

অমর বাবু আজ আমাদের মাঝে নেই। স্কুলে শিক্ষক থাকাকালীন তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে অল্প কিছু দিনের মধ্যে সবাইকে ছেড়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। মৃত্যুর বেশ কয়েক মাস আগে ওনার বাবার চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু দিন ঢাকায় ছিলেন। তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালে থেকে নিরলসভাবে বাবার সেবা করেছিলেন। এর পর তিনি নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি ঢাকায় আসেন আবার চিকিৎসার জন্যে। তাঁর একমাত্র ছেলে অমিত তখন ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র। এ সময় আমি একদিন ওনাকে আমাদের বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলাম। মগবাজার মধুবাগের ছোট্ট বাসায়। তিনি আসলে আমি নবাব সিরাজদৌল্লাহ নাটকের ক্যাসেট বাজিয়ে শুনিয়েছিলাম হাই ভলিউম দিয়ে। তিনি পুরো সময়টা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন। তিনি ক্লাস অনেক বার সিরাজের সংলাপ আমাদের শুনাতেন। আমি অনেকটা পরিকল্পনা করেই কাজটা করেছিলাম। শেষ হলে ক্লাসের মত গল্প করে আবারও বুঝিয়েছিলেন। সে টেপটা আজও আমার কছে আছে। তাঁর মৃত্যুর দিন আমি ঢাকা থেকে মোংলায় পৌঁছি। সকালে কাইনমারী পৌঁছে রাস্তায় খবরটা পাই। কাইনমারীর এক পাগল ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, অমর বাবু চলে গেলেন। আমার বিশ্বাস হয় নি, ভয়ে ভয়ে বাড়ীর সামনে গিয়ে দেখি অনেক মানুষের ভীড়! বিকালে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় স্কুলের অনেক স্যারের সাথে আমার সেখানে দেখা হয়েছিলো।

শ্রী বিমল কৃষ্ণ মন্ডল। সেন্ট পলসের একজন সুদর্শন শিক্ষকের নাম। তিনি শ্রী সুরেন্দ্র নাথ মন্ডলের আপন ছোট ভাই। উনি আমাদের ইংরেজী দ্বিতীয় পত্র পড়াতেন। ওনার পড়ানোর ধরণটা ছিলো ধীর গতিতে। আস্তে আস্তে কথা বলতেন, আর একটা বিষয় পড়ানোর পর ক্লাসে কাজ দিতেন। বেশী চাপ দিতেন না আমাদের। মিষ্টি চেহারার এই শিক্ষককে আমি চিনতাম সেন্ট পলসে পড়ার আগে থেকেই। তিনি সব সময় মিষ্টি হেসে আস্তে আস্তে কথা বলতেন। তবে এর মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠতো। ঢাকায় আমার বাসায় ওনার সাথে আমার বেশ কিছু দিন থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো। আমরা দু’জন এক সংগে রিক্সায় বেশ ঘোরাঘুরিও করেছিলাম। তিনি ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় এসেছিলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উনি ওনার পুকুরে মাছ আর পুকুরের চারিপাড়ে জাঙলা করে সিমের চাষ করেছিলেন। আমিও ওনার দেখাদেখি সেই কিশোর বয়েসে আমাদের বাড়ীর পুকুরে রুই-কাতল মাছের চাষ আর চার পাড়ে জাঙলা করে সিম লাগিয়ে বেশ লাভবান হয়েছিলাম। রুই মাছের চাষ বলতে তখন বর্ষার শেষে মাছের পোনা কিনে পুকুরে ছাড়া। কাঁধে করে মাছের পোনা বিক্রি করতে সে সময় লোকরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতো, আর শ হিসাবে গুণে গুণে পুকুরে ফেলতো। সত্যি কথা বলতে মাছ চাষের জন্য তখন আলাদা ভাবে কোনো খাবার দিতে হতো না। পুকুরের ঘাস, শ্যাওলা, লতাপাতা ও পুকুরের বিভিন্ন জৈব পদার্থ খেয়েই মাছেরা রীতিমতো বেড়ে উঠতো। একদিন ওনার পুকুরটা নিজের চোখে দেখার জন্য এক বন্ধুকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম।

বিমল বাবু আজ প্রবাসী, শুনেছি অসুস্থ এখন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ওনার বড় কন্যার কাছেও কিছুদিন ছিলেন। এখন ছোট কন্যার কাছে থাকেন। আমি ওনার দ্রুত সুস্থতা কামনা করি।

শ্রী অশোক কুমার বিশ্বাস। সেন্ট পলস হাই স্কুলের এক পরিশ্রমী উজ্জ্বল বিজ্ঞান শিক্ষকের নাম। ওনার সম্বন্ধে এ লেখায় আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা আগে উল্লেখ করেছি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে উনি আমাদের অংকের শিক্ষক ছিলেন। প্রচন্ড প্রতাপে আমাদের কাছ থেকে বাড়ীর কাজ আদায় করে নিতেন। পড়াশুনায় অমনোযোগ, অনিয়ম, সিগারেট খাওয়া এসব তিনি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। এর জন্য তাঁর কঠোর শাস্তি থেকে কেউই রেহাই পেতো না। পরবর্তী কালে উপরের ক্লাসে তিনি আমাদের অনেক সহযোগিতা করতেন। প্রতিটা বিষয় পড়াতেন তিনি পরীক্ষা পাশ করার জন্য নয়, বরং বিষয়টাকে আমাদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন। ক্লাস নাইনে আমরা যারা বিজ্ঞান পড়েছিলাম, তাদের সবার এ কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। এ সময় তিনি আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসের জীববিজ্ঞান আর রসায়ন বই কেনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি ভীষণভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে আসতেন; আর তাতে ক্লাসের একটা মুহুর্তও নষ্ট হতো না। তাঁর হাঁটা-চলা কথাবার্তার মধ্যে একটা প্রখর গাম্ভীর্য থাকতো সব সময়। সেটা ছিলো স্কুলের ভিতরে ও বাইরে সমান ভাবে।

অশোক বাবু শুধু শ্রেণিকক্ষেই পাঠদান করতেন না, তিনি পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে শিখতে শিক্ষার্থীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন। এই ধারা অনুসরণে শিক্ষক থাকা অবস্থায় হলদিবুনিয়া থেকে সংগৃহীত করে সেন্ট পলস হাই স্কুলে নিজেই এই ক্যাক্টাস গাছটি লাগিয়েছিলেন ২০০৩ সালে। পনর বছর পর ২০১৮ সালে তোলা সেই গাছটির ছবি এবং গাছটির পাশে অশোক বাবুর ছবি । এই সময় তিনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। সূত্র – ফেসবুক, অশোক কুমার বিশ্বাস।

অশোক বাবুর দু’টি বড় গুণ ছিলো, তিনি পড়াশুনা আর নিয়ম নীতির প্রশ্নে কোন ছাত্রকেই ছাড় দিতেন না। আর দ্বিতীয় গুণটা হলো, পুরানো ছাত্রদের সংগে তিনি একদিকে সন্তান তুল্য ও অন্যদিকে এক পর্যায়ে বন্ধু তুল্য ব্যবহার করতেন। আমি আমার জীবনে তাঁর কাছ থেকে এ দু’টি বিষয়েই উপভোগ করেছি, আর এখনও করছি। একটা ছোট ঘটনা যেটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। একবার বড় বয়েসে ঢাকা থেকে মোংলায় এসে দীর্ঘ সময় স্যারের সাথে ঘোরাঘুরির পর বিদায়ের মুহুর্তে স্যার হাতে ধরে থাকা তাঁর সাইকেলটি হঠাৎ ঘুরিয়ে কেমন ভাবে যেন আমাকে ‘যাও’ বলে বিদায় দিয়েছিলেন! স্যারের বাইরের দিকটা আমি যত শক্ত আর কঠোর হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছিলাম, তাঁর ভিতরটাকে তত স্নেহ আর মমতায় পূর্ণ হিসাবে উপলব্ধি করেছিলাম। আমি তাঁর সুস্থ ও আনন্দময় দীর্ঘ জীবন কামনা করি।

শ্রী কালিপদ রায়। সেন্ট পলস হাই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের এক তুলনাহীন অদ্বিতীয় শিক্ষকের নাম। অল্প উচ্চতার স্বাস্থ্যবান পরিপাটি পোষাকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এক আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন তিনি। বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর বিদ্যাবত্তার তুলনা তিনি নিজেই। নবম-দশম শ্রেণীতে আমাদের পদার্থ বিদ্যা, ঐচ্ছিক গণিত ও সাধারণ গণিত পড়াতেন তিনি। তাঁর ব্যক্তিত্বে অতি গাম্ভীর্যের আড়ালে অসাধারণ রসবোধ ছিলো মধ্যরাতে হঠাৎ সূর্যরশ্মির মতই। এ রসবোধ সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহল ছিলেন, তারা কখনও অতি সিরিয়াস শিক্ষক হিসাবেও তাঁকে ভয় করতো না। সে দলের আমিও একজন। পাঠ্য বিষয় হিসাবে তাঁর জ্ঞান ছিলো পিরামিডের মতো স্থায়ী, অতি সংহত। ক্লাসে তাকে তাঁর কোন বিষয়ে শিক্ষা দিতে গিয়ে সামান্যতমও প্রস্তুতিহীন দেখি নি কখনো।

অতি সিরিয়াস বিষয়ে পাঠদানের সময় তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ মজার সব উদাহরণ দিতেন। আমাদের আঞ্চলিক যে ভাষায় আর ভঙ্গীতে তিনি পড়াতেন, তা মনে পড়লে আজও মনে মনে হাসি পায়। তাঁর সেই সব উদাহরণ গুলো অতি সাধারণ ছাত্রকেও পরিস্কার ভাবে বিষয়টি বুঝতে আকৃষ্ট করতো। তাঁর দেওয়া কয়েকটি বিষয়ের উদাহরণ আর রসাত্বক কথা এখানে উল্লেখ না করে পারলাম না। প্রচলিত শুদ্ধ বাংলায় লিখলে স্যার সৃষ্ট রসবোধের হানি হবে। তাই চেষ্টা করলাম তাঁর নিজস্ব রসমিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করতে। এর জন্য আশা করি পাঠকরা বিষয়টা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি নিয়ে দেখবেন। স্যারের এ বিষয়গুলো তাঁর সংগে সুদীর্ঘ বৈঠকে বসে একদিন তাঁর সাথে শেয়ার করে ছাত্র হিসাবে এক স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করেছিলাম। প্রতিক্রিয়ায় তিনি মাথা নীচু করে শুধুই হেসেছিলেন। তাঁর সে সলজ্জ মুখটি আমার চোখের সামনে আজও ভাসে!

মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বুঝাতে গিয়ে:
“এই তুমি (ক্লাসে রঞ্জিৎ নামে এক দুষ্ট ছেলেকে) আজ সয়ালে স্কুলি আসার সোময় পোলের পরে একটা কুঁহুর রে নাথি মারে খালে ফেলে দিলে, কুঁহুরডা উপরে না যাইয়ে নিচেয় পড়লো ক্যান? এডাই মাধ্যকর্ষণ শক্তি।”

নিমজ্জিত অবস্থায় ভাসমান বস্তু বুঝাতে গিয়ে:
“কানমারীর খালে বেবদি জাল ধরে দেহিছো? কেউ জাঁলের(জেলে)পরে রাগ করে দুরিত্তে কাঁচা ঝাইল ছাড়ে দিলি জাঁলে তা দেখতি পারে না। ঝাইল ভাসে কিন্তু জলের নিচে দিয়ে। উপরেত্তে দ্যাহা যায় না। এডা অলো নিমজ্জিত অবস্থায় কোন বস্তুর ভাসা। এ অবস্থায় জলের নিচে জিনিসটা ওজন শূণ্য মনে অয়।”

বাড়ীর কাজ চেক করার সময়:
“বিকাশ রায়,
সমান সমান চিহ্ন দেও নি বায়।”
“সুযশ দে, — এ–, কী দেবো রে তোরে, সাইন্স না আর্টস?”
উল্লেখ্য, সুযশ শ্রেণীর পাশে কোন্ গ্রুপ তা লিখেছিলো না।

একবার পরীক্ষা চলাকালীন দোতলায় পরীক্ষার হলের স্টেজের উপরে দাঁড়িয়ে বোর্ডিং এর একটা লম্বা লাল হাফ প্যান্ট আর সাদা হাফ শার্ট পরা কিশোর ছাত্র এক্সট্রা কাগজ চাইলো। ছেলেটি ছিলো ভীষণ শুকনা, আর অনেক লম্বা। স্যার, কাগজ— বলে সে পিছনের দিকে তাকালো। কালিপদ বাবু ছিলেন হলের পিছন দিকে এক গাঁদা কাগজ হাতে নিয়ে আমার সীটের কাছাকাছি। স্যার এক হাত উপরে তুলে দূর থেকে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বললেন: “এই — বয়–, পড়ে যাবি ” — বলে তিনি তার দিকে অতি দ্রুত হেঁটে গেলেন। স্যারের এই রশিকতাটা বুঝে পরীক্ষার হলেই মনে মনে অনেক ক্ষণ হেসেছিলাম। (চলবে)


লেখক পরিচিতি

দীপক রায় – পূর্ণ নাম: দীপক কুমার রায়। জন্ম এস এস সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ৭ই জানুয়ারী, ১৯৬৩। বৃহত্তর খুলনার অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় মালগাজী গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় শ্রী ধনঞ্জয় রায় এবং মা শ্রীমতি অমলা রায়। মোংলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার দৌলপুরে সরকারী ব্রজলাল কলেজ থেকে যথাক্রমে এস এস সি এবং এইচ এস সি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।

চাকরি জীবন শুরু ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর, ঢাকায় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার একটা স্কুলে সিনিয়র ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার হিসাবে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ওই চাকরি থেকে ইস্তাফা দিয়ে বর্তমান পর্যন্ত স্বনিযুক্ত প্রশিক্ষক হিসাবে বিদেশী শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা ভাষার শিক্ষাদানের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। এক ছেলেও এক মেয়ের বাবা। ছেলে সুদীপ্ত রায় ঢাকার একটি বৃহত্তর বেসরকারী হাসপাতালে রেজিস্ট্রার ডাক্তার হিসাবে কর্মরত। মেয়ে শর্মিষ্ঠা রায় পরিবেশ বিজ্ঞানে সম্মান সহ সম্প্রতি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিয়েছে।

বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতে গভীর ব‍্যুৎপত্তি ও অনুরাগসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী দীপক রায়। তাই কাজের ফাঁকে নিজের সন্তুষ্টির জন্য লেখা-লেখি নিয়ে সময় পার করেন। ফেসবুকে জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে কবিতা লিখে থাকেন প্রতিদিনই, নিয়মিত। গান শোনা তাঁর অন্যতম প্রধান শখ। বিশেষতঃ রাগ প্রধান গান – এ উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ব্যপক আগ্রহ। যখনই অবসর পান গান শুনে সময় কাটানোই তার নিয়মিত অভ্যাস।