মনোজ কান্তি বিশ্বাস – কবিতাগুচ্ছ

শৈশবের নদী

– মনোজ কান্তি বিশ্বাস

আমার শৈশবের নদীটি
আজ আর কোনো নদী নেই
ভূমিদস্যুদের দখলে পাখনা মেলেছে
বহুরুপী সভ্যতার অজনকল্যাণ!
আমি হারিয়েছি আমার শৈশবের ডুবসাঁতার শীতল স্নেহ, আর সাধারণ হারিয়েছে নদী ব্যবহারের ন্যূন অধিকার।
মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া গেলেও নদীর সমস্ত উপকরণ ধূলিষ্যৎ, একটা শেওলাও চোখে পড়ে না আজকাল।
কেন জানেন? আমার শৈশবের বটবুনিয়ার মত এ দেশে হাজারও নদী খালের মালিক এখন জনপ্রতিনিধি অথবা
তাদের প্রোশ্রিত অশিষ্টজন,
অথচ একদিন ভোর হতেই সোহবান চাচা, নরেন জ্যাঠুরা
সাত তাড়াতাড়ি ঘলসা জালের ফাঁদে আর খেপলা জালে মাছ ধরে ঘরে ফিরলেই পরিবার ব্যস্ত হতো কেটে রান্নার কড়াইতে চাপাতে।
একদিন এই স্বাধীন নদীগুলো ভরা বর্ষায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ছিলো
নতুন সভ্যতা এসে নদীরমুখে বেড়িবাঁধ দিয়ে কুলুপ এটে দিয়ে নদী শাসন করেছে।
দেশ হারাচ্ছে নদী, আমরা হারিয়েছি শৈশব।

শরৎ সঙ্গম

– মনোজ কান্তি বিশ্বাস

সব ক্লান্তি গুলো বিবর্ণ বিকেল হয়ে
দিগন্তে খুলে দিলো মনের বন্ধ দরজা
শরৎ শুভ্র মেঘ কাশফুলের সঙ্গম।
মেঘের আড়ালের রঙ দেখেছে কে কবে?
আমি দেখলাম চিরানন্দ তোমার শুভ্র মেঘে।
তোমার সুহাস দখিণা মনের কোণ
সমুদ্র নির্ভয়ে এসে করে আলিঙ্গন!
নিস্তব্দ দুপুরে পাখিদের দূর আকাশ ছিলো-
ঘুম্ ঘুম্ বিকেলে তারা নামে ঘাসের ফড়িংএ।
শরৎ চেয়ে থাকে সমুদ্রজল ঢেউয়ে
সূর্যের রঙে রাঙাহয় চাঁদের মত বাঁকা
একফালি ঢেউ! ফিঙের কাজল চোখ বুঝি সমুদ্রের জলের শরীরে নাব্যতা আনে।
চুপিসারে বলে গেলো
শরৎ এনেছে শিউলি -সন্ধার আবছায়ে,
ঝাউগাছের মগডালে শো শো গর্জন
আসে পূর্ণিমার চাঁদ, শরৎ সঙ্গমে।
আলিঙ্গন মুখর তৃষ্ণার্ত চাতক
শরৎ এসেপড়ে কাশফুল আর মেঘে,
কাব্যতীর্থ হয়ে যায় শরৎ বৈঠক
নানা বর্ণের গন্ধনিয়ে ছন্দ হাটে-
শরৎ জোছনায় স্নান সারা ভোরে
তোমার নির্মল হাসির প্রশান্ত আঙিনায়।

চড়ুইভাতি

– মনোজ কান্তি বিশ্বাস

তোমার শিশির ​ ঘাসে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ আমার চড়ুইভাতি,​
তোমার স্বপ্ননাগাল চাঁদ​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ আমার জাগা রাতি।​
শিউলি ​ ঝরা বিকেল গুলো​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ আমার চাঁদের হাসি,​
বর্ণচোরা স্নিগ্ধ ​ রাতে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ তোমার কাছেই আসি।​
শাপলা শালুক ​ নেইতো ​ সেথা​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ শিশির ​ ভেজা ​ ঘাস,​
শরৎ চাঁদের শোভায় থাকি​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ আমরা বারোমাস।​
আমার তুমি মন ছুঁয়েছ​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ঝরা বকুল মালা,​
উদাস দুপুর মধ্য পুকুর​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ মন ছিলো উতলা।​
বন পেরিয়ে লাজ ভুলে যাই​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ তোমায় হাতে পেয়ে,​
একলা দুজন যাই হারিয়ে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ বেড়াই গান গেয়ে।​
সকাল থেকে বিকেল হলো​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ যায় গড়িয়ে বেলা,​
ঘুঘুর ডাকে সাঙ্গ হলো​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ শেষ বিকেলের খেলা।​
আকাশ কেঁদে ​ বৃষ্টি নামে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ তোমার ভেজা মন,​
অস্ত রবি বলছে ডেকে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ আর কি প্রয়োজন?​
গোধূলি ​ ওই রঙ ধরেছে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ফেরার সময় হলো,​
চড়ুইভাতি সাঙ্গ করে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ এবার ঘরে চলো।

চলে যাওয়া

– মনোজ কান্তি বিশ্বাস

কীভাবে ভুলে থাকতে হবে
পৃথিবীর যাবতীয় রূপকথা?
কীভাবে ছেড়ে যেতে হবে-
কোনো অঙ্কে নেই সমাধান।
শেষকৃত্য, স্মরণসভা বড়জোর-
জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী বছরান্তে,
শোকের নদী ভরাট হলে-
কর্মকোলাহলে জীবন যেখানে যেমন।
ধূসর অতীত, নগ্নস্মৃতি, একাকীত্ব, মায়াজালছিন্ন বিশ্বচরাচর –
আয়ূষ্কালের কটাদিন, অতপর যোগবিয়োগ অঙ্কের চূড়ান্ত সমাধান।
চলে যাওয়ার জন্যই পৃথিবীতে আসা, অথচ রাখিনা মনে।
ব্যাঙ্কের টাকা, সম্পদের মোহ, স্বজন, সবকিছু ফেলে যেতেই হয়,
এর চেয়ে আর কোনো সত্যে বিচলিত হয়নি কোনোদিন।।


কবি পরিচিতি

মনোজ কান্তি বিশ্বাস। জন্ম ১৯৭৫ সালে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার মাইটভাঙ্গা গ্রামে। বটিয়াঘাটা হেড কোয়ার্টার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, বটিয়াঘাটা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং সরকারি ব্রজলাল কলেজ থেকে বাংলা সম্মান সহ এম এ পাস। কর্মজীবনে একজন গবেষক ও স্বনামধন্য অধ্যাপক। গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ এর দুটি গবেষণার প্রজেক্টের সাথে। বর্তমানে কর্মরত আছেন বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে মোংলা উপজেলায় অবস্থিত মোংলা সরকারি কলেজ-এ ২০০২ সাল থেকে।

স্কুল জীবন থেকে কবিতা লেখার সূত্রপাত। কলেজে পড়াকালীন সময়ে কবিতা ও প্রবন্ধ রচনায় বেশকিছু পুরস্কার পান তিনি। এসময় বেশকিছু দৈনিক পত্রিকায়ও তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর লেখা কবিতার বই ও শিক্ষার্থীদের জন্য বইও প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে যুক্ত আছেন বিভিন্ন সৃজনশীল লেখা-লেখির সাথে। বেশি পছন্দ কবিতা পড়া ও লেখা। নদী, প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র ও জীবনবোধের প্রকাশই তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।