আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ৯
– দীপক রায়
যাঁর মাধ্যমে আমি সেন্ট পলস্ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম তিনি শ্রদ্ধেয় মি: অমর পিটার সরকার। অত্যন্ত সিরিয়াস, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও কড়া প্রকৃতির শিক্ষক। তিনি আজ আর ইহজগতে নেই। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। তাঁর সঙ্গে আমার যে ব্যক্তিগত সম্পর্কটুকু ছিলো তা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম ছিলো বলে আমার বিশ্বাস। তিনি বিনা কারণে ছাত্রদের সাথে কথা বলতেন না। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই করিয়ে দিতেন। সবাইকে সময় বেঁধে দিতেন ক্লাসে পড়ার জন্যে, আর নিজের দু’হাত বুকের সাথে বেঁধে ক্লাসময় হেঁটে বেড়াতেন। বেঁধে দেয়া সময় শেষ হলেই তিনি আমাদের পড়া ধরতেন। কেউ পড়া না করে ক্লাসে আসলে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখতেন পড়াটা করে না দেয়া পর্যন্ত।
আমি যখনই তাঁর কাছে কোন কাজে বা ওনার সিগনেচারের জন্য যেতাম, উনি কোন কথা না বলে শুধু ওনার মন্তব্য লিখে সাইন করে দিতেন। একবার আমার ওনার সিগনেচারের দরকার হয়। শুনলাম উনি অসুস্থ আর অদূরে সেন্ট পলস হাসপাতালে ভর্তি। টিফিনের সময় সাহস করে ওনার বেডে গিয়ে ফর্মটা এগিয়ে দিতেই উনি যথারীতি আমাকে ফ্রীশিপ দিতে সুপারিশ করে দিলেন। কাজটা তিনি প্রতি বছরই আমার জন্যে করতেন। ভর্তি হওয়ার পর থেকে শেষ বছর পর্যন্ত তিনি নীরবে আমাকে সাপোর্ট করে গেছেন।
আমি তখন ক্লাস এইট বা নাইনের ছাত্র। এক দিন তিনি হঠাৎ করে ক্লাস শেষে বললেন তাঁর পড়াবার বিষয় বাংলা ব্যাকরণ বইটা তাঁর বাড়ীতে রেখে যাওয়ার জন্যে; কারণ প্রশ্নপত্র তৈরি করবেন পরীক্ষার জন্য। আমি স্কুলে আসা-যাওয়া করতাম কাইনমারী ও হলদিবুনিয়ার পথ দিয়ে। সেদিন স্যারের বাড়ীতে বইটা দেয়ার জন্যে মালগাজী দিয়ে তাঁর বাড়ী হয়ে স্কুলে যাই। এটা ছিলো আমার দ্বিতীয় বার তাঁর বাড়ীতে যাওয়া। স্যারদের বাড়ীতে অনেক কুকুর ছিলো। ভয়ে কম লোকে তাঁদের বাড়ীতে যেতো। তবে স্কুলে ক্লাস সিক্স ছাড়া প্রতি ক্লাসে মনিটর হিসাবে এরকম বেশ কিছু দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হতো।
এর পর বহু বছর কেটে গেলো। সেভাবে স্যারের সাথে তেমন আর দেখা হয় নি। বছর ৪/৫ আগের কথা। মোংলায় গিয়ে অশোক বাবুর সংগে ওনার বাসা থেকে পোর্টের দিক দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলাম। অশোক স্যারকে আগেই বলেছিলাম শেলাবুনিয়ায় রাস্তার পাশেই অমর পিটার স্যারের সাথে একটু দেখা করে যেতে চাই। কেন জানি আমি মন থেকেই চাইছিলাম। স্যার সারা জীবনই একটু কড়া প্রকৃতির। ছাত্রদের সবাই বেশ ভয় পেতো ওনাকে। সে হিসাবে কেউ কেই স্যারকে কম মিশুক মানুষ হিসাবে ভাবতো আর খানিকটা এড়িয়েও চলতো। দেখলাম বাসার সামনে উনি তাঁর সবজি ক্ষেতের পরিচর্যা করছিলেন। আমি নমস্কার দিয়ে কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করতেই উনি ভালো বলে কাজ বন্ধ করে আমাকে ভিতরে আসার আহ্বান করলেন। সেদিনের সেই বিশাল ভালো লাগাটুকু অনুভব করতে গিয়ে এ মুহূর্তে আমার চোখে জল এসে গেলো! উনি কম কথা দিয়েই আমাদের আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ণ করলেন। রেখা দিদিমণি নিজের হাতে মিষ্টিসহ চা ও অন্যান্য খাবার খেতে দিলেন। ছেলেদের ছবি দেখালেন, তাদের কাজ সম্বন্ধে বললেন। আমিও ওনাকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ করে অশোক বাবুর সাথে উঠে আসলাম।
এর কিছুদিন পরে শুনলাম দিদিমণির মৃত্যু সংবাদ। আর তারও পরে স্যারের হঠাৎ চলে যাওয়ার খবরে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। আমার সেন্ট পলস স্কুলে পড়তে পারার পিছনে অমর পিটার সরকার স্যারের অবদান সারা জীবনই মনে রাখবো!
ক্লাস সিক্সে কিছু দিন শ্রী চক্রধর মজুমদারকে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম। তাঁর সংগে আমার ব্যক্তিগত তেমন যোগাযোগ না থাকলেও মানুষ হিসাবে তিনি অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ বলে আমার বিশ্বাস। তিনি একটা সময় সেন্ট পলস্ স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে দু’টো সাধারণ ঘটনার কথা, যা কোন দিন ভোলার নয়, এখানে উল্লেখ না করে পারছি না।
প্রথম ঘটনাটা ১৯৭৭ এর সম্ভবত: ফেব্রুয়ারীতে। আমি তখন এস. এস. সি. বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী। মার্চ মাসে আমাদের পরীক্ষা। তবুও আমরা নিয়মিত ঠিক সময় স্কুলে এসে জাতীয় সঙ্গীত-এ অংশ গ্রহণ করতাম। সে দিন আমার ও আমার এক সহপাঠীর স্কুলে পৌঁছাতে একটু দেরী হয়। জাতীয় সঙ্গীত চলছিলো, তাই আমরা দু’জন প্রবেশ পথে বিজ্ঞান ভবনের দেওয়ালের গা ঘেঁষে ছায়ায় দাঁড়িয়েছিলাম। ভেবেছিলাম জাতীয় সঙ্গীত শেষ হলেই সবার সাথে ক্লাসে ঢুকবো। তখন হঠাৎ করে আমাদের তখনকার সহকারী প্রধান শিক্ষক মহোদয় (কার্যতঃ তখন তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিলেন) শ্রী নীরোদ বিহারী পোদ্দার মহাশয় তাঁর রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে আমাদের ওখানে দাঁড়ানো দেখতে পান আর কেমন অবিশ্বাস্য ভাবে ও কন্ঠে আমাদের দু’জনে দেরিতে আসার শাস্তি স্বরূপ দৌড়িয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করতে বলেন। নীরোদ বাবুর সঙ্গে আমার এক রকম সম্পর্ক সেই ক্লাস সেভেন থেকে। স্কুলের ভিতরে ও বাইরে যে সময় দেখা হয়েছে, নিজ থেকেই কথা বলেছেন। সেদিনের ঘটনার সাক্ষী পিটি শিক্ষক স্বয়ং চক্রধর বাবুও। আমরা এ অসম্ভব আদেশ মানতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। নীরদ বাবু তখন গেটের দিকে হাত দেখিয়ে বার হয়ে যেতে বললেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নীরোদ বাবু তখন আমাদের “তুই” বলে সম্বোধন করছিলেন। আমার সাথে থাকা সহপাঠী পরমানন্দ তখন বাড়ী ফিরে যাবে বলে আমাকে জানালো। আমি যেতে চাইলাম না। গেটের বাইরে দেয়ালের কাছে দু’জনে দাড়িয়ে থাকলাম। প্রথম ঘন্টা পড়ার পর নীরোদ বাবু গেটের বাইরে এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। জানি না, তিনি কী ভাবে বুঝেছিলেন আমরা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
ছেলেদের ডে শিফটের ক্লাস শুরু হতো দুপুর ১২টায়। ক্লাস ও প্রাক্টিক্যাল ক্লাস শেষ করে বাড়ী ফিরতে অন্ধকার হয়ে যেতো। সেদিন বাড়ী ফেরার পথে অন্ধকারে রাস্তায় খালি গায়ে চক্রধর বাবুর সাথে দেখা হয়। তিনি হলদি বুনিয়ায় বিমল বাবুর বাড়ীতে লজিং থাকতেন। বিমলদার বাড়ীর পর ফাঁকা জায়গাটা পার হলেই আমাদের বাড়ী। তিনি অন্ধকারে বিশেষ কাজে রাস্তার পাশে ক্ষেতে ছিলেন। হঠাৎ ধানক্ষেত থেকে বেরিয়ে এসে আমার সংগে কথা বললেন। এত কড়া শিক্ষক হয়েও তিনি সেদিন যে ভাবে আমার সাথে কথা বললেন তা আমার স্পষ্ট মনে আছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন সে দিন নীরোদ বাবুর আদেশ পালন করতে গিয়ে আমাদের সংগে তাঁর ব্যবহারের জন্য। তিনি এমন কথাও বলেছিলেন আমারা যেন ওনাকে মাফ করে দিই। তিনি শুধু প্রধান শিক্ষকের আদেশ পালন করেছিলেন, মন থেকে নীরদ বাবুর কথায় সায় দেন নি। আমি ওই দিন সত্যি আবাক হয়েছিলাম আমার প্রতি বা স্কুলের একজন ছাত্রের প্রতি স্যারের ভালোবাসা দেখে। আমার প্রতি তার স্নেহের আরও একটা ঘটনা এখানে না লিখে পারছি না।
ঠিক কত সালের কথা আমার সঠিক মনে পড়ছে না। তবে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের পড়ি। শিক্ষা বোর্ডের এস. এস.সি. ও এইচ. এস.সি. সার্টিফিকেট ইংরেজীতে করার জন্য ঢাকা থেকে যশোর বোর্ড অফিসে আসি। বোর্ড থেকে বলা হলো স্কুল ও কলেজের যথাক্রমে প্রধান শিক্ষক ও প্রিন্সিপালের কাছ থেকে সম্মতি পত্র বা ওই জাতীয় চিঠি দরকার। যশোর থেকে সরাসরি দৌলতপুর এসে বি. এল. কলেজ থেকে চিঠিটা সংগ্রহ করলাম। এর পরদিন ভোরে মোংলায় পৌঁছে স্কুল গেটে আসলাম। সময় কম ছিলো। বাইরে পড়াশুনা করতে যাওয়ার একটা চেষ্টায় আমাকে ওই দিন রাতেই ঢাকায় ফিরতে হয়। তাই গ্রামের বাড়ীতে যাওয়া আর হয়ে উঠলো না। এসে দেখি স্কুল গেট বন্ধ। স্কুল গেটের ঠিক সামনের দোকানটায় জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে দেখি দোকানদার হিসাবে চক্রধর বাবুকে। শুনেছিলাম উনি স্কুলের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করছেন। দোকানের মালিক হিসাবে সাধারণ কাপড়ে ওনাকে দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। উনি আমাকে জানালেন স্কুল বন্ধ থাকার কথা। আমার আসার উদ্দেশ্যের কথা জেনে আমাকে বসতে বললেন। পরম যত্নে নিজ হাতে দোকানের চিড়া ভিজিয়ে গুড় দিয়ে আমাকে খেতে দিলেন।
এর পর তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন রমেশ বাবুর বাড়ী যেতে, কারণ স্কুলের অফিস রুমের চাবি ওনার কাছে থাকতো। আমি তখন এন্থনী রমেশ হালদার বাবুর বাড়ীতে গেলাম। ওনার বাড়ী সুদান বাবুর বড়ীর সামনে। আমার কথা শোনার পর উনি নীরোদ বাবুর বাড়ীতে যেতে বললেন, কারণ চিঠিতে নীরোদ বাবুর সই দরকার। আমার ঠিক মনে পড়ছে না, হয়তো সুদান বাবু তখন কিছু কালের জন্য স্কুলের বাইরে ছিলেন কি না। রমেশ বাবু আমাকে ভালো চিনতেন (আমার বিশ্বাস এখনও মনে রেখেছেন), আর আমাকে সেদিন আন্তরিক ভাবে সহযোগিতাও করেছিলেন।
আমি নীরোদ বাবুর বাড়ীতে গেলাম। সেটা ছিলো আমার প্রথম বার তাঁর বাড়ীতে যাওয়া। উনি তখন বারান্দায় বসে সকালের খাবার খাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে খুব অবাক হয়েছিলেন। তখনকার দিনে ছাত্ররা শিক্ষকদের বাড়ীতে গেলে হয়তো তাদের বসতে বলার রেওয়াজ ছিলো না। স্যার শুধু আমাকে বললেন: তুমি স্কুলে যাও, আমি আসছি। সেদিন আমার তিনজন প্রাক্তন শিক্ষক আমাকে যেভাবে সহযোগিতা করেছিলেন, তা কোনদিন ভুলতে পারবো না। অন্যদের কাছে হয়তো বিষয়টা সামান্য, কিন্তু আমার কাছে তা অমূল্য স্মৃতি হয়ে আছে।
রমেশ বাবুর সাথে আমার যে সম্পর্কটা হয়েছিলো, তার পিছনে হয়তো একটা কারণ ছিলো। সেটার পিছনে একটা ছোট্ট কিন্তু মনে থাকার মতো ঘটনা ছিলো। সেন্ট পলস্ হাই স্কুলের ইতিহাসে এ পর্যন্ত দীর্ঘতম সময় ধরে যিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি হলেন মি: ফ্রান্সিস সুদান হালদার মহোদয়। তিনি দশম (বিজ্ঞান) শ্রেণীতে আমাদের ইংরেজী পড়াতেন। এ সময় কিছু দিন তিনি স্কুলের বাইরে ছিলেন। সে সময় সাময়িক ভাবে রমেশ বাবু আমাদের ইংরেজী প্রথম পত্রের ক্লাস দিতেন। একদিন ক্লাসে তিনি একটা গল্প পড়াতে গিয়ে ওই গল্পের মধ্যে একটা বিষয়ে আমাদের একটা অর্থ বলে তা আমাদের ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। যদিও বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার আর সহজ ছিলো। আমার মনপুতঃ না হওয়াতে আমি ভিন্নমত পোষণ করলাম, কিন্তু ক্লাসে প্রথম সারির কিছু সহপাঠীবন্ধুও তাঁকে সমর্থন করলো। আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলাম। রমেশ বাবু তখন প্রধান শিক্ষকের অফিস থেকে আমাকে ডিকশনারি আনতে বললেন। সাইন্স ভবনে আমাদের পাশের রুমেই প্রধান শিক্ষকের অফিস। আমি অফিসে ঢুকতেই টেবিলে কর্মরত নীরোদ বাবু চোখ না তুলেই জিজ্ঞাসা করলেন: কী দীপক? আমি বললাম, স্যার ডিকশনারি। আমি জানতাম ডিকশনারি কোথায়। তিনি আর কিছু জানতে চাইলেন না। উল্লেখ্য নীরোদ বাবু তখন সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে স্কুলের দায়িত্বে ছিলেন। আর হেড মাস্টার ছিলেন ফা: কার্লো রুবিনী মহোদয়। তিনি নিতান্ত দরকার ছাড়া স্কুলে আসতেন না, মিশনের অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
ডিকশনারি দেখে রমেশ বাবু বললেন, ঠিক আছে দীপক, নীরোদ বাবুর সংগে কথা বলে কাল জানাবো। পরের দিন ক্লাসে ঢুকেই রমেশ বাবু ইংরেজীতে বললেন: You are right Dipak. আর তখন থেকে তিনি আমাকে একটু বেশী স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। সর্বশেষ ওনার সংগে আমার দেখা স্কুলের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের দিন পৌঁছাতে আমার বেশ দেরি হয়। কোন একটা সমস্যার কারণে তখন স্কুলের প্রধান ফটক বন্ধ রাখা হয়। ভিতরে বাইরে অনেক পুলিশ ছিলো। কারণ প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক কেয়ার টেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান। পুলিশ গেট খুলতে অস্বীকার করলো। খবর পেয়ে রমেশ বাবু সেদিন গেট খুলে আমাকে সহ বেশ কয়েকজন পুরানো নিমন্ত্রিত ছাত্রকে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
শ্রী অনিল বিশ্বাস। অংকের শিক্ষক। আমাদের, সবার প্রিয় অংকের অভিজ্ঞ শিক্ষক অনিল বাবু। স্বল্পভাষী, নীতিবান শিক্ষক ছিলেন। তিনি আজ আমাদের মধ্যে আর নেই। নবম ও দশম শ্রেণীতে তিনি আমাদের সাধারণ গণিত পড়াতেন। ক্লাসের বাইরে তিনি আমাদের সাথে বড় একটা কথা বলতেন না। আমার ধারণা, তিনি কিছুটা লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। যদিও মুখ দেখে তেমন মনে হতো না। সব সময় নিজের মধ্যেই যেন নিজেকে রাখতেন। তবে ক্লাসে পাঠদানে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন।
তাঁর কথা মনে রাখার মতো আমার কয়েটা ঘটনার কথা আজ বলতে চাইছি। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়। এক দিন ক্লাসে অনিল বাবু জ্যামিতির একটা এক্সট্রা করতে দেন। স্যার কয়েক জনের খাতা দেখে ঠিক করে দেন। এর পর আমি দেখাতে গেলে তিনি রাইট চিহ্ন দিয়ে ভালো বললেন। সবাইকে বললেন, প্রমাণ করার জন্য দীপকের পথটা সহজ আর কম লিখে তা করা যায়। এমনকি তিনি বললেন, ওর খাতা নিয়ে তোমরা দেখে নাও। স্যারের অকপটে সব বলার বা স্বীকার করার গুণ ছিলো।
ক্লাস টেনে উঠে ক্লাস টিচার হিসাবে অনিল বাবুকে পেলাম। তিনি টেনেও জেনারেল ম্যাথের ক্লাস দিতেন। নতুন ভবনে প্রথম ক্লাস। অন্যরকম অনুভূতি। ক্লাস নাইন পাশ করে মেয়েরা মর্নিং সেশান থেকে আমাদের সাথে একই ক্লাসে যোগ দেয়। স্বাভাবিকভাবেই ক্লাসটা নীরব ছিলো। সেন্ট পলস স্কুলে মেয়েদের সংগে একই ক্লাস রুমে বসার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। আমরা ক্লাসে তখন তিন রকম স্টুডেন্ট ছিলাম। এক. আমরা রেগুলার ছেলেরা। দুই. মর্ণিং শিফট থেকে আসা রেগুলার মেয়েরা। আর তিন. সিনিয়র ভাইরা, যারা আগের বছর বা তারও আগে টেস্ট পরীক্ষায় পাশ না করায় এস. এস. সি. পরীক্ষা দিতে পারে নি। মেয়েরা ক্লাস রুমের উত্তর দিকটা পছন্দ করে – সকাল সকাল এসে বসে পড়ে। (চলবে)
লেখক পরিচিতি

দীপক রায় – পূর্ণ নাম: দীপক কুমার রায়। জন্ম এস এস সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ৭ই জানুয়ারী, ১৯৬৩। বৃহত্তর খুলনার অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় মালগাজী গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় শ্রী ধনঞ্জয় রায় এবং মা শ্রীমতি অমলা রায়। মোংলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার দৌলপুরে সরকারী ব্রজলাল কলেজ থেকে যথাক্রমে এস এস সি এবং এইচ এস সি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
চাকরি জীবন শুরু ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর, ঢাকায় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার একটা স্কুলে সিনিয়র ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার হিসাবে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ওই চাকরি থেকে ইস্তাফা দিয়ে বর্তমান পর্যন্ত স্বনিযুক্ত প্রশিক্ষক হিসাবে বিদেশী শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা ভাষার শিক্ষাদানের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। এক ছেলেও এক মেয়ের বাবা। ছেলে সুদীপ্ত রায় ঢাকার একটি বৃহত্তর বেসরকারী হাসপাতালে রেজিস্ট্রার ডাক্তার হিসাবে কর্মরত। মেয়ে শর্মিষ্ঠা রায় পরিবেশ বিজ্ঞানে সম্মান সহ সম্প্রতি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিয়েছে।
বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতে গভীর ব্যুৎপত্তি ও অনুরাগসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী দীপক রায়। তাই কাজের ফাঁকে নিজের সন্তুষ্টির জন্য লেখা-লেখি নিয়ে সময় পার করেন। ফেসবুকে জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে কবিতা লিখে থাকেন প্রতিদিনই, নিয়মিত। গান শোনা তাঁর অন্যতম প্রধান শখ। বিশেষতঃ রাগ প্রধান গান – এ উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ব্যপক আগ্রহ। যখনই অবসর পান গান শুনে সময় কাটানোই তার নিয়মিত অভ্যাস।