আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ৮
– দীপক রায়
আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন — ৮
এর পরের ১০ মাসের ঘটনা সম্বন্ধে লিখে সঠিক ভাবে প্রকাশ করা বোধ করি আমার মত নিতান্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষত: ওই সময়ে আমার বয়েস আর বিশেষ কিছু সীমাবদ্ধতার কথাতো থেকেই যায়। তবে যে ছবি আর আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে তা নিচে অতি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করলাম:
১. শরনার্থী ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন।
২. ডায়েরিয়া, আমশয় সহ বিভিন্ন রোগে ক্যাম্পে প্রতিদিন অনেক লোকের মৃত্যু। তাদের মধ্যে বৃদ্ধ আর অল্প বয়েসী ছেলে-মেয়েরাই ছিলো অধিক। শ্মশানে রাত দিন জয় বাংলার লোকদের মৃতদেহগুলো পুড়তে দেখার দুঃসহ স্মৃতি।
৩. পশ্চিম বাংলার প্রায় সব স্কুল-কলেজের ভবনগুলোতে বাংলাদেশের শরনার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষত: বারাসতে এ অবস্থাটা আমি দেখেছি। তাই দীর্ঘ ৯/১০ মাস এসব স্কুল কলেজে পড়াশুনায় ভীষণ ব্যাঘাত ঘটেছিলো বলে আমার ধারণা।
৪. শরনার্থীদের জন্য ট্রেনে কোন টিকেট দরকার হতো না। যে চাল-ডাল-পেঁয়াজ আমরা পেতাম তা ছিলো পর্যাপ্ত পরিমান। সেখান থকে কিছু বিক্রি করেও কিছু নগদ পয়সা পাওয়ার সুযোগ ছিলো।
৫. শরনার্থীদের জন্য কয়েকটা ক্যাম্পে নিয়ে একটা অস্থায়ী হাসপাতালের ব্যবস্থা ছিলো। সেখানে চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরনার্থী ডাক্তার আর স্থানীয় ডাক্তার। এছাড়া কিছু বিদেশী ডাক্তারকেও দেখেছিলাম মাঝে মাঝে। এর মধ্যে একটা সংস্থার নাম মনে আছে। দ্যা সালভেশন আর্মী সঙ্গে CASA নামক একটা সংস্থা। পর্যাপ্ত ওষুধ পত্রও ছিলো তাদের সাথে।
৬. আমার বাসে চড়তে ভালো লাগতো না। মাথা ঘুরাতো, বমি আসতো। তাই বাসে না চড়ে লম্বা পথ হেঁটে যেতাম পাকা রাস্তার পাশ দিয়ে। ২০ পয়সায় সুস্বাদু স্লাইস করা রুটি পাওয়া যেতো তখন। পকেটে পয়সা থাকলে কিনে খেতাম একা একা। রাস্তায় গিয়ে চায়ের দোকানের সামনে বাঁশের তৈরী বেঞ্চির উপর বসে রাস্তার গাড়ী দেখতাম, বাংলাদেশগামী মুক্তি যোদ্ধাদের বয়ে নেয়া পুরানো মাথা নীচু বাসগুলি দেখে আমি অনেক আনন্দ পেতাম। এসব বাসে বাংলাদেশ থেকে আগত যুবকরা ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশে ঢুকতো মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যুদ্ধ করতে। জানালা দিয়ে তারা হাত নাড়তো। তাদের দেখে কীযে ভালো লাগতো! ভাবতাম হয়তো খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে পারবো।
৭. পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ যখন চুড়ান্ত পর্যায়ে তখন আকাশে দেখতাম প্রায় সারাদিন ভারতীয় যুদ্ধ বিমান। দল বেঁধে প্রচন্ড শব্দ করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতো। ক্যাম্পের বাংলাদেশীদের চায়ের দোকানে বসে শুনতাম বজ্র কন্ঠ (বঙ্গ বন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ) আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। শুনতে শুনতে গানগুলো মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো।
আমাদের ক্যাম্পে CASA নামক সংস্থা একটা স্কুল চালু করে। মোটা তাবুর নীচে স্কুল ঘর করে সেখানে ক্লাস হতো। বই খাতা কলম সব তারা দিয়েছিলো। বাংলাদেশের শরনার্থীদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষক ছিলেন, তাঁরা ওখানে কাজ করতেন। একদিন যুদ্ধের মধ্যে হঠাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পেলাম। আমাদের আনন্দ দেখে কে!
৮. এ সময় একদিন বারাসাত স্টেশনে দাঁড়িয়ে দেখলাম একটা ট্রেন ধীর গতিতে স্টেশন অতিক্রম করছে। অনেক উৎসুক লোকের সঙ্গে ট্রনের মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম যুদ্ধে পরাজিত বন্দী পাকিস্তানী সৈন্যদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা চুপ করে মাথা নীচু করে বসে আছে। জনতা তাদের দিকে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিলো।
৯. এর কয়েক সপ্তাহ পরে জানুয়ারীর (‘৭২) এক মেঘলা সকালে ঠান্ডার মধ্যে ট্রাকে করে আমরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। স্থানাভাবে আমি ও আমার মামাতো ভাই ট্রাক ড্রাইভারের মাথার উপর ছোট জায়টায় গিয়ে বসলাম। দীর্ঘ কষ্ট সাধ্য ভ্রমণের সারা পথই ঠান্ডার মধ্যে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিলো। ভিজেই চলছিলাম। বর্ডার পার হবার পর পথে সন্ধ্যা আসলো।
জীবনে প্রথম বাংলাদেশের পাকা সড়ক পথ ধরে চলছিলাম। অনেকটা একই রকম তেলের গন্ধ। ভিজে রাস্তার পাশে এ্যারো চিহ্নিত রাজধানী ঢাকার পথের দিক নির্দেশনা আমার মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলো। এক সময় বেশ রাতে খুলনা শহরে এসে আমাদের ট্রাক থামলো। সে এক আনন্দময় অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। খানজাহান আলী রোডের প্রাইমারী শিক্ষকদের ট্রেনিং সেন্টার কম্পাউন্ডের মধ্যে টিনের ছাউনি দেয়া সেমিপাকা ভবনে আমাদের আশ্রয় দেওয়া হলো। আজও সেই ঘরগুলো সেখানে রয়েছে। আমি ওখানটা দিয়ে যাওয়ার সময় ঘাড় বাঁকিয়ে একবার তাকিয়ে দেখি।
সকাল বেলা রামকৃষ্ণ মিশন থেকে চিড়া-গুড় নিয়ে আসি লাইন দিয়ে। সম্ভবত: আরো একটা রাত কাটিয়ে কী সব অফিসিয়াল ফর্মালিটিজ শেষ করে পরের দিন মোংলাগামী লঞ্চে উঠে বসি মামা বাড়ীর অন্য সবার সাথে। লঞ্চ তখন খুলনা থেকে ছেড়ে চিলা বাজার পর্যন্ত আসতো। আমরা আমাদের সুবিধার জন্য সবার সাথে চিলা বাজারে এসে নামি। মামাবাড়ী থেকে দেশে আগে ফেরা কেউ নৌকা নিয়ে লঞ্চ ঘাটে অপেক্ষা করছিলো। মনে আছে মালামাল আর এতগুলো মানুষের জায়গা নৌকায় হয় নি। তাই অন্যান্যদের সাথে হেঁটে চললাম কাঁচা পথ ধরে হলদিবুনিয়ায় মামাবাড়ীর দিকে। ক্লান্ত থাকলেও সদ্য স্বাধীন দেশে চেনা পথে হাঁটতে ভালই লাগছিলো। তাছাড়া এসময়ে কিশোর বয়েস। এক বছর পর বেশ লম্বা হয়েছিলাম। তার প্রমান পেয়েছিলাম মামাবাড়ী এসে দাদুর ঘরে ঢুকবার সময়। স্বাধীনতার আগে দেশে থাকতে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে দাদুর বড় ঘরে ঢুকতাম। দেশে ফিরে অভ্যাসবশত: একই ভাবে ঢুকতে গিয়ে মাথায় চৌকাঠের আঘাত লেগে মেঝেতে পড়ে যাই। কেমন যেন দম ব্ন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিলো। কোন রকমে সামলে নিই। তবে মাথার উপরের অংশে ব্যথা ছিলো বেশ কিছু দিন ধরে। বেশ লম্বা, হাত পা চিকন মনে হতো। গ্রামের কাকী জেঠিরা কেউ কেউ আমাকে ধরে পরখ করে লম্বা হওয়ার কথা বলতো। এক রকম হঠাৎ আসা দৈহিক শক্তি যেন আমাকে পেয়ে বসলো।
দেশে ফিরে যা দেখলাম তা অবিশ্বাস্য। তা এখানে লেখা সম্ভব নয়। শুধু একটা কথাই বলা যায়, আমাদের বাড়ীতে কোন ঘর ছিলো না। একটা পরিষ্কার ভিটা, নারকেল আর তাল গাছ আর পুকুর। তবে সেদিন আমি কোন কষ্ট অনুভব করি নি; দেশে ফিরতে পেরেছি সেই আনন্দে। মামা বাড়ীর একটা পরিত্যক্ত ঘরে মাস খানেক কটিয়ে কোন রকমে থাকা যায় এমন একটা ঘর তুলে আমরা পাঁচটি প্রাণী মালগাজী আমাদের বাড়ীতে চলে আসি।
সেই সময় দিন তারিখ রাখার বয়েস হয় নি। তাই নির্দিষ্ট ভাবে তা উল্লেখ করা গেলো না।
১৯৭২ সালের খুব সম্ভবত: ফেব্রুয়ারী মাসের কোন এক সকালে নিজের খেয়ালে বই-খাতা-কলম ছাড়া সেন্ট পলস স্কুলের প্রধান গেটে একা এসে হাজির হই। তখন মনের মধ্যে নির্দিষ্ট কোন আশা বা স্বপ্ন ছিলো না। পিতৃহীন হওয়াতে আগে থেকেই অনেকটা অবহেলিত আর ছন্নছাড়া জীবনে অভ্যস্ত হয়েই ছিলাম। পড়াশুনা আর আদৌ হবে কি না, সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম।
গেট দিয়ে ঢুকে বুঝলাম স্কুল আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। দেখলাম এই এক বছরে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। একজন কেউ আমাকে ডান পাশে নতুন তৈরি এক তলা ভবন দেখিয়ে দিলো। বেশ কিছুটা জীর্ণ পোষাকে কেমন একটা অস্বাভাবিক সাহস নিয়ে নতুন ভবনের প্রথম রুমে উঁকি দিলাম। অস্বাভাবিক এ কারণে বললাম, তখন আমি সদ্য কৈশোরে পড়া কিশোর, আর এ স্কুলে আমার নাম আছে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিলো। যা হোক, দেখলাম একজন চশমা পরা রোগা পাতলা তরুণ টেবিলে বসে দ্রুততার সাথে কিছু করছেন। ছাই রঙের খানিকটা ঢোলা প্যান্ট আর হালকা নীল রঙের হাতা গোটানো ফুল শার্ট। ইন না করে পরা। ভাবছিলাম কী বলবো, এনাকে তো চিনি না। তিনি চোখ তুলে আমার দিকে একটু গম্ভীর মুখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী চাই জাতীয় একটি প্রশ্ন। তিনি দেখতে এতই তরুণ যে তাঁর গাম্ভীর্য্যে আমার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো না। আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম যে আমি এই স্কুলে পড়তাম। ভাবখানা এমন যেন স্কুল অফিসের একজন কর্মচারীর সাথে কথা বলছি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আমার নাম আর ক্লাস। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পিছনের সেল্প থকে একটা ফী বুক খুঁজে বের করলেন, আর কোন কথা না বলে একটা স্লিপে খস্ খস্ করে কিছু লিখে তা আমার হাতে দিয়ে মিষ্টি অথচ গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ক্লাসে যাও। স্লিপটা হাতে নিয়ে দেখলাম তাতে ইংরেজীতে লেখা: ক্লাস সিক্স। রোল নম্বর ছাড়া। আমি আগের মতই সাধারণভাবেই জানতে চাইলাম: সেভেনে পড়া যাবে না? তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, না।
ওই রুম থেকে বের হয়ে ছোট সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে ভাবলাম ক্লাসে যাব কি না। বই খাতা কিছু আনি নি। শেষে ভাবলাম গিয়েই দেখি। সম্বভবত: দপ্তরি আমাকে ক্লাস সিক্সের রুমটা দেখিয়ে দিলেন।
স্লিপ নিয়ে ক্লাসে ঢুকলাম, আর পিছনে গিয়ে বসলাম। সে দিনের স্মৃতি আমাকে এখনও কষ্ট দেয়, কারণ অশোক বাবুর অংক ক্লাসে বাড়ীর কাজ ছাড়া আসা ছাত্রদের লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিলো। আমি বিনা বাক্যে লাইনে দাঁড়ানো শেষ ছাত্র আর শাস্তি পেতেও চেয়েছিলাম বিনা বাক্যে। প্রাইমারী স্কুলে পড়ার বছরগুলোতে কোনদিন শাস্তির আওতায় আসার দরকার পড়ে নি। হঠাৎ স্যার নতুন মুখের আমাকে দেখে কেমন মাথা একদিকে বাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন বাড়ীর কাজ করি নি। আমার উত্তর শুনে তিনি বেত দিয়ে সামনের দেখিয়ে আমাকে বসার হুকুম দিয়েছিলেন। তবে যা হবার তা এক বার হয়ে গিয়েছিলো ইতিমধ্যে। বেত্রাঘাত! এটা ছিলো আমার ছাত্র জীবনের প্রথম আর শেষ অনাকাঙ্খিত ঘটনা। এর জন্য আমি কোন ভাবেই যোগ্য ছিলাম না। এর পর এবং অনেক বছরও স্যারের কাছ থেকে যে আস্থা আর স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি, তা মনে করে সে দিনের সেই ঘটনাকে যেন বেশী করে মনে করতে চাই এখন!
কয়েক বছর আগে কথায় কথায় স্যারকে অনেক ঘটনার মধ্যে যখন এ ঘটনাটা বলেছিলাম, তখন স্যার আমাকে যা বলেছিলেন তা এখানে প্রকাশ করা কোন ভাবেই আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তবে একটা কথা এখানে না বললে নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে আমাদের শ্রদ্ধেয় এক বড় ভাই (যিনি এখন সুইডেন প্রবাসী, সম্প্রতি তাঁর সংগে আমার কথা হয়েছে অপ্রত্যাশিতভাবে) দ্বিজেনদার রুমে সাময়িকভাবে কিছু দিন ছিলাম। সে সময় আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অশোক কুমার বিশ্বাস এসেছিলেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ট্রেনিং নিতে। তিনি একদিন আমাদের সংগে জগন্নাথ হলের দক্ষিণ বাড়ীতে দ্বিজেনদার রুমে ছিলেন। আমাদের সংগে মানে মন্টু ( চিত্র শিল্পী প্রদীপ বিশ্বাস) আর আমার সংগে। দ্বিজেনদার সে কয়েকদিনের ত্যাগের কথা ভোলা যায় না। তিনি আমাদের থাকতে দিয়ে কোথায় কোথায় যে রাত কাটাতেন, তা আজও আমরা জানি না। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসাবে হলে তাঁর একটা ইমেজ ছিলো। রুমে ঢুকে শুধু তাঁর স্বভাবজাত মৃদু স্বরে বলতেন: কী খবর তোমাদের? আজ তা মনে করে কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে মনপ্রাণ!
স্যার হোস্টেলে সীট পেয়ে চলে যান। যাবার সময় আমাকে বলে যান স্যারের হয়ে আমি যেন দিদিমণিকে (স্যারের সহধর্মিনী) একটা চিঠি লিখে সব খবর জানিয়ে দিই। আমি মহা বিপদে পড়লাম। আমি দৌড়ে সিঁড়িতে ওনাকে থামিয়ে একটা সাদা কাগজে ওনার সইটা নিয়ে আসি। উনি তখন আমাকে বলেন, ওই যে…..ওদের নাম যেন কী? — ওদের কথাও একটু জানতে চেয়ে লিখো। মানে তাঁর দুই সন্তানের কথা। তরুণ আমি তখন আমার বুদ্ধিতে যা এসেছিলো, তা লিখেছিলাম চিঠিতে স্যারের হয়ে। তার উত্তরও দ্রুত এসেছিলো চিন্তায় থাকা এক স্ত্রীর কাছ থেকে। চিঠিটা স্যারকে পৌঁছে দিয়েছিলাম। এই হলেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক, বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ শিক্ষক শ্রী অশোক কুমার বিশ্বাস। তার সাথে আমার সম্পর্কের কথা যতদিন বাঁচবো মনে থাকবে। বেশ লম্বা বিরতির পর কিছুদিন ধরে তাঁর সাথে কথা হচ্ছে মাঝে মাঝে।
সেন্ট পলস্ স্কুল জীবনের পাঁচ বছরের অধিক সময়ে অনেক ছোট-বড় ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে অনেকগুলো হয়ত মনে নেই, তবে কিছু ঘটনা তো মনে আছে খন্ড খন্ড ভাবে।
এক দিন আমাদের ষষ্ঠ শ্রেণীতে বাংলা ব্যাকরণ পড়াতে আসলেন অফিসের সেই চশমা পরা পাতলা সুদর্শন যুবক। গম্ভীর অথচ অসম্ভব মোহনীয় কন্ঠে তিনি আমাদের পড়াতে শুরু করলেন। পড়া পারার কারণে অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর নজরে পড়লাম। জানলাম তিনি আমাদের স্কুলের যুগ্ম প্রধান শিক্ষক। সবাই ওনাকে ভয় পেতেন, কিন্তু আমি কেন জানি পেতাম না। হয়তো পড়া পারার জন্য। তিনি পড়া জিজ্ঞাসা করার সময় তাঁর মধুর অথচ শক্ত গলায় আমার নাম উচ্চারণ করতেন, তখন আমার ভীষণ ভালো লাগতো। পড়া না করা ছেলেদের তিনি লাঠি দিয়ে হাতে মারতেন। তাই সবাই তাঁকে ভয় পেতো খুব। মাঝে মাঝে কেউ ভয়ে ভয়ে অস্পস্ট উত্তর দিলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন তার উত্তর ঠিক হয়েছে কিনা। এক দিন স্যারের যে কোনভাবে পরিচিত একটি ছেলে, যে ক্লাসে আমার বেঞ্চে বসত, তার অস্পষ্ট উত্তর শুনে স্যার আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন তার উত্তর ঠিক হয়েছে কিনা। আমি মহা বিপদে পড়েছিলাম। কারণ তার উত্তরটি আংশিক ঠিক ছিল। ঠিক হয়নি বললে সে স্যারের মার খেতো। আর ঠিক হয়েছে বললে স্যার হয়তো আমার উপর অখুশী হতেন। সেদিন আমি বলেছিলাম মোটামুটি ঠিক হয়েছে। স্যার আমার মন্তব্য শুনে হেসে ফেলেছিলেন। সেদিন আমরা সবাই প্রথমবার তাঁর গম্ভীর মুখে মিষ্টি হাসি দেখেছিলাম! (চলবে)
লেখক পরিচিতি

দীপক রায় – পূর্ণ নাম: দীপক কুমার রায়। জন্ম এস এস সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ৭ই জানুয়ারী, ১৯৬৩। বৃহত্তর খুলনার অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় মালগাজী গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় শ্রী ধনঞ্জয় রায় এবং মা শ্রীমতি অমলা রায়। মোংলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার দৌলপুরে সরকারী ব্রজলাল কলেজ থেকে যথাক্রমে এস এস সি এবং এইচ এস সি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
চাকরি জীবন শুরু ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর, ঢাকায় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার একটা স্কুলে সিনিয়র ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার হিসাবে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ওই চাকরি থেকে ইস্তাফা দিয়ে বর্তমান পর্যন্ত স্বনিযুক্ত প্রশিক্ষক হিসাবে বিদেশী শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা ভাষার শিক্ষাদানের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। এক ছেলেও এক মেয়ের বাবা। ছেলে সুদীপ্ত রায় ঢাকার একটি বৃহত্তর বেসরকারী হাসপাতালে রেজিস্ট্রার ডাক্তার হিসাবে কর্মরত। মেয়ে শর্মিষ্ঠা রায় পরিবেশ বিজ্ঞানে সম্মান সহ সম্প্রতি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিয়েছে।
বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতে গভীর ব্যুৎপত্তি ও অনুরাগসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী দীপক রায়। তাই কাজের ফাঁকে নিজের সন্তুষ্টির জন্য লেখা-লেখি নিয়ে সময় পার করেন। ফেসবুকে জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে কবিতা লিখে থাকেন প্রতিদিনই, নিয়মিত। গান শোনা তাঁর অন্যতম প্রধান শখ। বিশেষতঃ রাগ প্রধান গান – এ উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ব্যপক আগ্রহ। যখনই অবসর পান গান শুনে সময় কাটানোই তার নিয়মিত অভ্যাস।