সুমিত্র দত্ত রায় – কবিতাগুচ্ছ – ২

তখন জগৎ আমায় ঘিরে

– সুমিত্র দত্ত রায়

সেই দূরবীনটা হারিয়ে গেছে।
শৈশবে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার,
কৈশোরে টারজান- অরণ্যদেব,
যৌবনে প্রেমিকা বা দেবদাস,
আজ দূরবীনটা হারিয়ে গেছে।

সেই বাঁশিটাতো ভেঙেই গেছে।
সবুজ ক্ষেতে রাখালিয়া সুর,
খেলার মাঠে খেলার হূইসেল,
কলেজ পথে ট্রেন ছাড়বার ভোঁ,
আজ বাঁশিটাতো ভেঙেই গেছে।

আজ নাটক আমায় ঘিরে আছে,
আজ সাহিত্য আমায় ঘিরে আছে,
আজ বিজ্ঞান আমায় ঘিরে আছে,
কিন্তু আমি কাউকেই ঘিরে নেই-
কাউকে ধরা দিচ্ছি না মনেপ্রাণে।

সবার থেকেই আজ আমি দূরে ।
দূরবীনে ধরা পড়ি না এখন,
বাঁশি সুরেই বাজে না এখন,
ওরা আমার কঙ্কাল নিয়ে নাচে-
মনটাকে জানতে চায় নি বলে!

শুধুই একবার,
জানতে চায়নি বলেই …

ভাতঘুম

– সুমিত্র দত্ত রায়

আজ ভাতঘুম ক্লান্তি আমার দুচোখ জুড়ে,
হতভাগ্য মানুষ যেন স্থিরনেত্রে দুয়ারে।
মানুষের মৃত্যু হয় স্বীয় মনের ভিতরে,
এখন দুটি পা বন্দী অজস্র তরু শিকড়ে।

মাটির মানুষকে বুলবুলি গান শোনায়,
কচুপাতার মোম গা থেকে বৃষ্টি ঝরে যায়।
ভয়ে ও শীতলতায় মরণ লুকোতে চায়,
শব্দে নয়, শব্দ আজও নীরব প্রতীক্ষায়।

জরাজীর্ণ ছবি বেচেই – বাঁচা মহান হয়ে,
কষ্ট পাই। শুধু স্বপ্নে ট্রিগার আঙুল ছুঁয়ে!
আমার আঙুল সবচিহ্ন মুছে দেয় ধুয়ে,
আয়নায় দেখি শুয়ে আছে এক চেনা রাজা।

আসবো না ফিরে।

– সুমিত্র দত্ত রায়

কালো কালবোশেখী কিছু এড়াতে,
প্রথম আশ্রয় নিয়েছিলাম ও ঘরে।
তুলসী তলাতেও সাঁঝবাতি দিতে,
তাই এ পতঙ্গমন বন্দী হয়ে পড়ে।

ভাব কেন, আমি উড়তে পারি না?
কেন রাখ খাঁচায় শুধু বন্দী যন্ত্রণা।

মনে আছে! হঠাৎই ছাদ চেয়েছিলে,
হার মানলাম। ফের গালগল্প চলে।
উড়তে হবে,দাবী সামলাতে গেলে।

ভেবেছিলে ছাদে যদি আগাছা বাড়ে;
ঝড় উঠবে হাওয়াও বদলাতে পারে।
ভাবনি,আমিই যে আসবো না ফিরে।

অন্যতর

– সুমিত্র দত্ত রায়

কখনো কি ভেবে দেখেছো?
তোমার আঁখির মধ্যে থাকা
অনুভূতির চঞ্চলতা
অন্য কারো মনে
কি ভীষণ আঘাত হানতে পারে!

কখনো কি জেগে দেখেছো?
স্বপ্নের মায়াবী স্পর্শ থেকেও
জীবন্ত পরশ
কত আকর্ষণে
কত বেশি নিজের করতে পারে!

কখনো কি গেয়ে দেখেছ?
গানের কলির মধুর আবেশ
সুর লালিত্যের
কথাতে ঝঙ্কারে
সাগরে কতটা ডুবে যেতে পারে!

তুমি দেখনি
কিন্তু আমি তো দেখেছি।

তোমার নয়ান তারা
তোমার মৃদু পরশন
তোমার গীতি মাধুরী
আমাকে কিভাবে কাছে এনেছে,
আমি তা জেনেছি।

তুমি বোঝনি
কিন্তু  আমি তা বুঝেছি।
যন্ত্রণা সয়ে
আমি তাই দূরত্ব গড়েছি!

শুধু তোমারই জন্যে

– সুমিত্র দত্ত রায়

আমার ভাবনা –
যেন হালকা একরাশ ধোঁয়া,
যায় না ছোঁয়া,
হাতে গড়া কাগুজে বিমানের মত ভাসে,
দুরন্ত বাতাসে।

তোমার ভাবনা –
উদ্দাম লহরে আবৃত সাগর অতলে,
আপন দখলে।
তাঁর মুক্তো সম্ভার, কোন সুদূর থেকে,
আমায় ডাকে।

একমুখী দুজনের ভাবনার সংগম স্থলে,
হঠাৎ কখনো কোন সুতনুকা জলপরী এলে,
গান গেয়ে যায়, ভরা পূর্ণিমায়।
সেই গান জীবনেরে,
ভরায় সোনালি অক্ষরে।

তখন, আমার সমস্ত কাজের পাহাড়,
মুহূর্তে ভেঙে চুরমার।
সে খুঁজে পায় সুন্দর সবুজ এক উপত্যকা।
তোমার উদার আশ্রয়ে চেয়ে  দেখি
নানান রঙে…একি!
আমারই তো জীবন রয়েছে আঁকা।


কবি পরিচিতি

সুমিত্র দত্ত রায় কবির ছদ্মনাম। প্রকৃত নাম সংকেত চট্টোপাধ্যায়।

আমি ছেলেবেলা থে‌কে ভাগীরথী কূলে বড় হয়েছি। আমার একাধিক লেখার প্রেরণায় গঙ্গার ভুমিকা অনেক। ওখানেই দেখেছি সূর্যাস্ত বা তৎকালীন মেঘরঞ্জনী। আদি বাড়ির কথা দিদির চোখে দেখা। বরিশালের শোলক গ্রামেই পিতৃভূমি ও বাটাজোরে মাতুলালয় ছিল। পিতা ঈশ্বর যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাতা ঈশ্বর বিজনবালা দেবী। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী রুমা চট্টোপাধ্যায় আর এক কন্যা সপ্তদ্বীপা চট্টোপাধ্যায়। ভাই নেই। দুই দিদি, গীতা মুখার্জী আর অঞ্জনা মুখার্জি। পিতা যোগেশচন্দ্র ছিলেন দেশপ্রেমিক। বরিশাল হতে বন্দী হয়ে দমদম সেন্ট্রাল জেলে বদলি হন। তাঁদের রক্তে কিছুটা দুঃসাহসী আমিও ছিলাম। কিন্তু কবিতার জগত আমার নিজস্ব মনে হত সেই দশবছর বয়সেই। আবৃত্তি, গান, ছবি আঁকা আমার খুবই পছন্দসই ছিলো। চাকুরিজীবী ছিলাম। এলাহাবাদ ব্যাংকে আধিকারিক। বদলির চাকরি। তাই ২০১২ সালে স্বেচ্ছায় অবসরের পর বাংলা কবিতা ডটকমে লেখা শুরু,  আমার কন্যাপ্রতিম সোমালীর হাত ধরে। আর পিছু ফিরে তাকাই নি, এখন ওটাই ধ্যান জ্ঞান।