সোমদেব চট্টোপাধ্যায় – কবিতাগুচ্ছ

একবার বলে দেখো

– সোমদেব চট্টোপাধ্যায়

একটা একটা করে সন্ধ্যার দীপমালা জ্বলে ওঠে,
তুমি ওদের সুখের নক্ষত্র বল!
তুমি কি জান একটি কর্মহীন যুবক
কী ভাবে সুখ খুঁজে নেয় সান্ধ্য কুয়াশা করতলে
কী করে সামলায় বিদ্রুপবিদ্ধ হৃদয়ের
এলোমেলো বিভ্রান্ত ভালবাসা কপাটিকা
উৎসবের মরশুম আগেভাগেই নিশ্চুপ
জীবনের জুয়া খেলা নিপুন চরকিবাজী
আর, তুমি তাকে শুভ দীপাবলি বল!
ঘামে ভেজা প্রতিটি অস্থিরতার কোরক
জন্ম জন্মান্তরের সুপ্ত বাসনা সুখ দায়
লাশকাটা ঘরে ক্ষত বিক্ষত কলজে ঘ্রাণ
তাকে তুমি সাধারণ ব্যবচ্ছেদ বল!
কী দরকার বৈভব বিত্ত বৃত্তের শূন্যতা …
ভুলের মাশুল তো মকুব হয়নি কারো
‘ভাল আছো?’ এইটুকু বললে কী হয়?
একবার অসময়ে বলে দেখলেই পারো!

মুক্তিযুদ্ধের শিশু

– সোমদেব চট্টোপাধ্যায়

প্রিয় শহর ঢাকায়, শীত সন্ধ্যার মুখে
আমি, মনোয়ারা ক্লার্ক মৌ
হেঁটে চলেছি অনাথ কুকুরছানা বুকে
না আমি হিন্দু, না মুসলমান
আমি যুদ্ধশিশু, লক্ষ লক্ষ লাঞ্ছিতা মা
আমার বাঙালি মায়ের নাম
নোয়াপাড়া আমি হেঁটেছি অনেক
দেখেছি খুলনার চটকল
‘জল্লাদভূমি’, বুড়িগঙ্গার পাড়
হাজার হাজার সমাধিস্থল …
নারী মুক্তিযোদ্ধা তালিকা
ছুঁয়ে দেখেছি লক্ষ বার
ওরা পিশাচ, ওরা কুৎসিত
ওরা ছিল বর্বর হানাদার
আমি শুনেছি ওদের হুকুম ছিল
সব ছেলেদের মেরে ফেলো
আর সব মেয়েদের গর্ভে
ভর, সন্তান -নাপাক
ওরা চেয়েছে বাঙালি তছনছ হয়ে
ভূখন্ড থেকে মুছে যাক
আমি দেখেছি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে
বীভৎসতম ইতিহাস
লক্ষ লক্ষ শিশু হাবিবের
বিবস্ত্রা মায়ের লাশ
আমি শুনেছি সেনার হাতে বদলানো
যাতনার শত রাত
শরীরে বেয়নেটের ক্ষত
কত অশ্রু, রক্তপাত
আমি শুনেছি মা রাতে চালের গুদামে
আশি বার ধর্ষিতা
আমি দেখেছি কত আগুন হ’লে
কত দিন জ্বলে চিতা
আমি, মনোয়ারা ক্লার্ক মৌ
আমি শুনেছি ফিরদৌসী বা রওশানা
বা কোনো মানেকা আমার মা
আমি জেনেছি বিজয় দিবসের মানে
বাঙালি হেরে যেতে পারে না
ঘন কুয়াশার বুকে দেখেছি আমি
শেখ মুজিবের নাম
শাস্তির খোঁজে …
শান্তির খোঁজে, প্রিয় বাংলাদেশের নাম

এমন প্রেমই আমি চেয়েছিলাম

– সোমদেব চট্টোপাধ্যায়

এই অবাধ্য প্রেমই আমি চেয়েছিলাম
এই অভুক্ত প্রেমই আমি চেয়েছিলাম

সহস্র অতিমারী কিংবা মহামারীতেও
তুমি আমাকে ফেলে যাওনি

অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অগ্ন্যুৎপাত
এমনকী প্রবল ভূকম্পনেও
তুমি চির অবিচল ছিলে

তুমি কাউকে কখনো বলোনি
চোপরাও বেয়াদপ! কথা শোন!

অথচ, পরাজিত পরাক্রমী ভূস্বামীর মতো
নত মস্তকে
যাবতীয় পার্থিব শক্তি
এবং অপার্থিব
তোমাকে স্বীকার করে নিয়েছে

তুমি কাউকে কবি হওয়ার জন্যে
প্ররোচিত করোনি
অথচ, পৃথিবীর সব দেশে, সমস্ত ভাষায়
শুধু তোমাকে নিয়েই
কবিতা আছে কয়েক লক্ষ

শত বিদ্রুপ কিংবা লাঞ্ছনাতেও
তুমি আমাকে ফেলে যাও নি

আমার মনের থেকে সমস্ত গ্লানি
অসত্য দোষারোপ
তুমিই সযত্নে মুছিয়ে দিয়েছো
তোমার ছিন্ন আঁচলখানি হয়েছে মলিনতর

অথচ, তুমি কখনো বলোনি
তোমারও যে কিছু চাইবার ছিল

অথচ, এক অন্ধকার দরিদ্র কুটিরে
অভাবময় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন আলোকবিন্দুর মাঝে
তোমার ভীরু, সজল চোখ দুখানিতে
আমি পৃথিবীর সমস্ত অভাব দেখেছিলাম

এই অবোধ্য প্রেমই আমি চেয়েছিলাম
এই আশ্চর্য প্রেমই আমি চেয়েছিলাম

যতবার এক একটি মৃত্যু হয়
এই শহরে, গ্রামে কিংবা অন্য কোথাও
তুমি তার প্রত্যেকটিতে নিজেকে অপরাধী ভেবেছো
অথচ যাদের উচিৎ ছিল
তারা কেউ ভাবেনি,
অনাহারে, অনিদ্রায়, শঙ্কায়, কখন কে মারা যায়!
প্রতিটি মৃত্যুর পিছনে আসলে কে দায়ী?

তবু,
তোমার স্পর্শেই অসংখ্যবার বেঁচে উঠতে ইচ্ছে হয়
এই পোড়া ভারতবর্ষের বুকে,
শুধু তোমার জন্যেই আমি বারংবার জন্মাতে চাই

কখনোই কোনো সংগ্রামে, কোনো ব্যর্থতায়
তুমি আমাকে ফেলে যাওনি

প্রতিটি মানুষের জন্যে
তোমার কাছে

এই অবাধ্য প্রেমই আমি চেয়েছিলাম
এই অভুক্ত প্রেমই আমি চেয়েছিলাম।


কবি পরিচিতি

সোমদেব চট্টোপাধ্যায়। জন্ম বিহারের কাটিহার জেলা শহরে৷ শিক্ষা এবং কর্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস৷ ইতিমধ্যে এমবিএ (ফাইনান্স), এমবিএ (মার্কেটিং), পিজি ডিপ্লোমা ইন ব্যাঙ্কিং, ও সিএআইআইবি ডিগ্রী সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া ২০১১ সালে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ব্যাঙ্কিং এন্ড ফিনান্স (মুম্বাই) আয়োজিত সর্বভারতীয় গবেষণা প্রতিযোগিতায় ‘ফিনান্সিয়াল অ্যাওয়ারনেস’ পেপারের জন্যে। বর্তমানে একটি উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে কর্মরত।

মূলতঃ বাবার অনুপ্রেরণায় লেখালেখি শুরু। দৈনিক সংবাদপত্র, বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, ওয়েবসাইটে লেখালেখির ভিতর দিয়ে ৷ প্রথম কবিতা সংকলন – বৃষ্টি যেরকম (২০০৮)। অর্জন করেছেন ২০১১ সালে ‘শিল্প মনন সাহিত্য পদক সম্মাননা’ ও ২০১৮ সালে ‘সৈকত সাহিত্য সম্মাননা’। এছাড়া ইংরেজি ভাষায় কবিতার আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট ‘PoetrySoup.com’ -এর বিচারে River personification এর অন্যতম সেরা উদাহরণ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে দুটি ইংরেজি কবিতা। বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘দেশ নিরুদ্দেশ’, ‘বাজেয়াপ্ত কবিতাগুলি’, ‘আমি ভারতবর্ষকে দেখেছিলাম’ – উল্লেখযোগ্য আবৃত্তিকারদের কণ্ঠেও শোনা গিয়েছে এই কবিতাগুলি। এছাড়াও প্রবন্ধ, ছোটগল্প এবং ভ্রমণকাহিনী স্থান পেয়েছে দৈনিক স্টেটসম্যান, আপনজন ইত্যাদি সংবাদপত্রে।

কবির ইচ্ছে – প্রকৃতির কোলে ছোট্ট কুটিরে বসবাস; ভালোবাসা – ছবি আঁকা, ফোটোগ্রাফি, গান শোনা, ফুলের গাছ; এবং নেশা – উন্নয়ন ও গবেষণা, সমাজ কল্যাণ।