দীপক রায় – আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ৭

আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ৭

– দীপক রায়

এক সময় অন্ধকারে কালিকাবাড়ী গ্রামে এসে খালের পাড়ে আমাদের নামতে বলা হলো। যারা সে সময় কিশোরী আর যুবতী ছিলো তারা শাড়ী পরে ছিলো, তাদের নিয়ে তাদের মা-বাবাদের দুঃশ্চিন্তার আর অন্ত ছিলো না। মনে আছে, তাদের সম্ভাব্য বিপদ আর পরিত্রাণের উপায় নিয়ে সবার মধ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আলোচনা হলো। এর পর সিদ্ধান্ত হলো একটা ছোট খাল ধরে চিলা বাজারের কাছে খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের গ্রামে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করা হবে। সেই মতো ছোট খাল দিয়ে নৌকাগুলো টেনে টেনে সরদার বাড়ীর পিছনে গিয়ে পৌঁছালাম এক সংগে আমরা অনেক লোক। কত লোক, তা হিসাব করার মত বয়েস বা আগ্রহ কোনটাই আমার তখন ছিলো না। রাত তখন ভোর হয়ে গেছে।

ওরা আমাদের গ্রহণ করলো। হয়তো কোন চুক্তির মাধ্যমে। তবে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকদের সাহসের প্রশংসা করতে হয়। তারা আমাদের নিরাপত্তা দিতে যথেষ্ট তৎপর ছিলো। সরদার বড়ীর একটা ছেলের সাথে আমার একটুখানি পরিচয় হলো। সেও সেন্ট পলসের ছাত্র — এই সূত্রে। ছেলেটাকে গীর্জায় খোল বাজাতে দেখলাম। এতে আমার বেশ আস্থা জাগলো তার উপর। কারণ খোল বাদ্য যন্ত্রটা মূলত: হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাদ্য যন্ত্র। তার নাম প্রদীপ সরদার। বয়েসে আমার চেয়ে বড়। আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর আর ও তখন অষ্টম শ্রেণীতে। খুব কষ্টের মধ্যে সর্দার বাড়ীর মাটির দেয়ালের ঘরের বারান্দায় থাকার ব্যবস্থা হলো। আজ সেই পরিবারের কোন ব্যক্তির নাম মনে করতে পারছি না, অথবা আদৌ কারো নাম শোনার প্রয়োজন ছিলো কি না সে ব্যাপারটাও সত্যি ছিলো। থাকা মানে শুধু রাতের বেলাটা ঘুমানো। সারা দিন ছন্নছাড়া ঘোরা-ঘুরি এখানে ওখানে। তবে বড়ীর ভিতরেই। সর্দার বাড়ীর অনেক গুলো শরিক। তাই ঘোরাফেরার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিলো।

চিলায় আসার এক দিন পরেই মামাতো ভাইয়ের সাথে লুকিয়ে হলদিবুনিয়ায় মামা বাড়ীতে এক বার যাই বড়দের না বলে – একটা বিশেষ কারণে। কারণটা সামান্য হলেও আমার জন্য ছিলো বিশাল! সেদিন রাতে যখন আমরা চুপিসারে চিলায় আসি সেদিন মা আমার প্রিয় ইংলিশ হাফ প্যান্টটা পোটলায় নিতে ভুলে যায়। মনে পড়ে মেটে রং। মাত্র কিছু দিন আগে রায় বাড়ীর আশু দর্জির কাছ থেকে বানিয়েছিলাম ৫ টাকা দিয়ে। টাকাটা ছিলো আমার রোজগেরে। সম্ভবত: ধান কুড়িয়ে তা বিক্রি করে টাকাটা পাওয়া। তাই এক রকম কান্না পাচ্ছিলো প্রিয় প্যান্টটার জন্যে। তাই কাউকে না জানিয়ে ঝুঁকি নিয়ে মামা বাড়ীতে আসি প্যান্টটার খোঁজে। এসে দেখি সব লন্ডভন্ড। বাড়ী লুট হয়ে গেছে। আর লুট করেছে আশেপাশের গ্রামের পাকি প্রেমিক লোভী হিন্দু বিদ্বেষী লোকরা। চিলা থেকে কালিকা বাড়ী হয়ে হলদিবুনিয়া পর্যন্ত আসতে কতো কিছু যে চোখে পড়লো! পথে পথে হিন্দুবাড়ীর কিছু জিনিসপত্র! একদল দামী জিনিসগুলো লুটে নিয়ে গেছে। খারাপ জিনিস ফেলে গেছে পথে পথে, অথবা পড়ে গেছে নেয়ার সময়। এসব ফেলে যাওয়া জিনিস কুড়িয়ে নিচ্ছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অহিন্দু গরীব লোকরা। হিন্দুদের সে কী অসহায় অবস্থা! আজ ভাবলে কান্না পায়। আমরা ছোটো বলে রাস্তায় দেখা হওয়া দুষ্কৃতিকারীরা আমাদের উপেক্ষা করলো। অথচ কী ভয়ই না পেয়েছিলাম সে দিন!

আবারও এক ভোর রাতে চিলার সরদার বাড়ী থেকে আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা শুরু হলো। চিলার হাটে যাওয়ার জন্য যেখানে খেয়াঘাট ছিলো, তার কাছাকাছি একটা জায়গা থেকে আমরা অন্ধকারে নৌকায় উঠলাম। অনেকগুলো বড় নৌকা। অধিকাংশ নৌকার পিছনে ও সামনে দাঁড় চালানোর ব্যবস্থা ছিলো। আমি উঠলাম একটা ছোট নৌকায়। ছোট মানে নদীতে চলার জন্য ছোট। এ নৌকায় আর কে কে ছিলো আজ আর তা মনে নেই। তবে মহিলাদের বড় নৌকায় দেওয়া হয়েছিলো। আজ ভাবতে অবাক লাগে, কত অল্প সময়ে গ্রামের একই পাড়ার পাশাপাশি বাড়ীর পরিবারগুলোর মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে নৌকাগুলো কেনা হয়েছিলো বাজার দামের চেয়ে অধিক দামে এ জীবন মরণ সংকটের সময়। আমাদের নৌকা বহর চিলার হাট রেখেই পশুর নদী পাড়ি ধরলো পশ্চিম পাড়ে সুন্দর বনের দিকে। বিশাল খরস্রোতা পশুর। ভাটার পচন্ড স্রোতের অনুকূলে পাড়ি দিতে কষ্ট হলো না। অন্ধকার রাত। প্রায় শ খানেক নৌকা চুপ চাপ বেয়ে চললো সুন্দর বনে ঢোকার ডান দিকের প্রথম খালটির উদ্দেশ্যে। আমাদের ছোট নৌকাটির পাশে বসে নদীর জল অনুভব করছিলাম মাত্র ৬/৭ ইঞ্চি নিচে। আজ পর্যন্ত দীর্ঘ বছরগুলো ধরে এই ভয়ের স্মৃতিটা এখনও আমাকে তাড়া করে ফেরে; সেদিন যদি প্রবল স্রোতের তোড়ে আমাদের ছোট নৌকাটা ডুবে যেতো, তাহলে বাঁচার পথ থাকতো না। অথচ এর চেয়েও বড় আর ভয়ঙ্কর বিপদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে শুধু এই বিপদটির কথাই কেনো আমার মনে পড়ে, তা আজও বুঝতে পারি নি।

খালটায় প্রচন্ড ভাটার স্রোত। উজানে আমাদের নৌকার বহর পশ্চিম দিকে চলতে লাগলো ধীর গতিতে। তখনই বুঝতে পারলাম আমরা এক বা একাধিক পথ প্রদর্শকের পিছনে পিছনে যাচ্ছি। প্রচন্ড এক ভয়ের মধ্য দিয়ে আমরা ধীর গতিতে এগোচ্ছিলাম। খালের দু’পাশে সুন্দর বনের ঘন জঙ্গল। যে কোন সময় বাঘের আক্রমণ হতে পারে। আর জলে থাকতে পারে কুমীর। তবে বিপদের দিনে আর এত মানুষ দেখে বনের জন্তুরাও হয়তো কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। আস্তে আস্তে সকাল হলো। কিছু দূর যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত হলো বাথরুম আর সকালের খবার সারতে হবে। আমি মামাতো দুই ভাইয়ের সাথে কাদা চরে নেমে বনের মধ্যে গিয়ে উঠলাম। ভয়ে বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে কী করবো। কেউ কেউ গাছে উঠে বসলো। আর বললো সবাইকে, কী কী দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ মুড়ি চিড়া দিয়ে সকালের খাবার সারলো। কোন কোন নৌকার লোক পাড়ে নেমে কাঠ যোগাড় করে ভাত রান্নার ব্যবস্থা করলো। বাথরুম সেরে আমরা নৌকায় এসে বসলাম। ততক্ষণে বেশ সাহস বেড়ে গেলো। এর পর আবার পথ চলা(বাওয়া) শুরু হলো।

চিলা থেকে সুন্দর বনে ঢোকার এক সপ্তাহ পরে আমরা ভারতের হাসনাবাদ শহরে পৌঁছাই। এই সাত দিনের পথের কষ্ট আর ভয়ানক সব বিপদের মুখোমুখি হবার কথা আমার মতো একটা ছোট ছেলের পক্ষে অনুধাবন করা আর তা মনে রাখা সম্ভব ছিলো না। তবে যে বিষয়গুলো আমার মনে দাগ কেটেছিলো তা নিচে উল্লেখ করলাম:

১. সারাদিন হয়তো বা এক বেলা কোন রকম খেয়ে আমাদের দিন গেছে। সঙ্গে রাত দিন বনের মধ্যে বাঘের ভয়তো ছিলোই। খাবার জলের সমস্যাটা ছিলো অবর্ণনীয়। বনের খালের জল ছিলো ঘোলা আর অসম্ভব লবণাক্ত। আমার দিদিমা সাথে করে কিছু তেঁতুল নিয়েছিলো। আমি বুদ্ধি করে খালের মহা নোংরা ওই লবণ জলে তেঁতুল গুলে তৃষ্ণা নিবারণে উদ্যোগী হই। আমার এ উদ্ভাবনটা পরিবারের মধ্যে প্রশংসা পায়। এক দুপুরের পর হঠাৎ বৃষ্টি আরম্ভ হয়। আমি দ্রুত চিন্তা করে আমাদের সাথে থাকা একটা ছাতা মেলে ছাতার বাট উল্টো দিক করে পিছনটা একটা দস্তার কলসীর মধ্যে রাখি। দারুন একটা ব্যপার হলো, আর অন্যান্যরা তা দেখে জল সংগ্রহ করতে বসে গেল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। বৃষ্টিতে ভেজার ব্যাপারটা ছিলো আদিম যুগের মানুষের মতো। আমাদের নৌকায় কোন ছই ছিলো না। তাই বৃষ্টিতে ভিজে পরনের কাপড় প্রাকৃতিক ভাবে শুকিয়ে যেতো। ভাগ্য ভালো আমি বা আমার মত রোদেজলে বেড়ে ওঠা অনেকে কোন জ্বর বা অসুস্থতায় পড়ে নি; তবে কেউ কেউ জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়ে।

২. বনের মধ্যে খাল মাঝে মাঝে খুব ছোট ছিলো। খালের মধ্যে গাছের ডালপালা বড় হয়ে পথ বন্ধ হয়ে ছিলো। কারণ ওখান দিয়ে হয়তো কত বছর ধরে মানুষের চলাচল ঘটে নি। মনে আছে আমাদের পথ প্রদর্শকরা গাছের ডাল কেটে কেটে পথ তৈরি করে সামনে যাচ্ছিলো। তারা একাজটা করছিলো মোটা টাকার বিনিময়ে।

এক পর্যায় আমাদের নৌকার বহর বন থেকে বের হয়ে বনের গা ঘেষে চলতে লাগলো। তখন একটু ভালো লাগলো। এরই মধ্যে শুরু হল নতুন বিপদ। প্রতি রাতেই অন্ধকার নামতেই স্বদেশী ভাইদের মারমুখী অসভ্য বর্বরতা শুরু হলো। জঙ্গলের পশুরা যা করে নি, এদেশের কিছু মানুষরূপী জানোয়ার তার চেয়ে নিকৃষ্ট কাজ করতে শুরু করলো। প্রতিরাতে খোলা নদীতে দলে দলে এসে বন্দুক, দা-ছোরা দেখিয়ে টাকা-পয়সা, সোনা-দানা সব কেড়ে নিয়ে যেতে লাগলো। তারা মেয়েদের উঠিয়ে নিতে চেষ্টা করলো। আমি ঘুম চোখে টর্চের আলো ফেলে আমাদের সর্বস্ব লুট করতে দেখলাম। কয়েজন মেয়ের বাবাকেও কাঁদতে দেখলাম হাউমাউ করে। আজ মনে করতে পারি, হয়তো জানোয়ারগুলো মেয়েদের তুলে নিয়ে যাবার মুহূর্তে হতভাগ্য বাবারা তাদের হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করছিলো না নেয়ার জন্য। রাতের আলো-অন্ধকারে সে এক বিভৎস দৃশ্য। হয়ত সর্বস্ব দিয়ে তাদের নিবারণ করা গিয়েছিলো। রাতে ছোট ছোট নৌকায় আসা সেই জানোয়ারগুলো হয়ত এ স্বাধীন দেশে ভিন্নতর কৌশলে সংখ্যালঘুদের নিরন্তন ভাবে অশান্তির কারণ হয়ে বুক ফুলিয়ে বিচরন করছে এখনো।

৩. এভাবে সীমাহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে একদিন বিশাল শিবসা নদী পার হলাম। পরে একদিন রায়মঙ্গল নদী(সম্ভবত:) পাড়ি দিলাম। এ নদী ভারত ও বাংলাদেশ সীমানার মাঝখানে। পাড়ি ধরার মুহূর্তে এপারে দূরে দেখা গেলো পাকিস্তানী গান বোট টহলরত।আমরা ভয়ে তখন মৃতপ্রায়। হয়ত যেকোন মুহূর্তে তারা আমাদের পাখির মত গুলি করে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। কিন্তু না। চোখের পলকে দেখা দিলো দ্রুততর গতি সম্পন্ন কয়েকটি ভারতীয় গান বোট। তা যেন রক্ষা কর্তা হিসাবে আমাদের কাছাকাছি হাজির হলো। নেড়ি কুত্তার মত লেজ তুলে পালালো পাকিস্তানী বোটটি। আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে নৌকায় থাকা পাকিস্তানী পতাকাগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলাম নদীতে।

৪. ভারতের মধ্যে প্রবেশ করেও আমরা লম্বা সময় ধরে হাসনাবাদের দিকে চলতে থাকলাম। নদীতে যাত্রিবাহী লঞ্চ দেখলাম গায়ে ইংরেজীতে Calcutta লেখা। উত্তেজনা বোধ করছিলাম কোলকাতার দিকে যাচ্ছি ভেবে। আমার কোন ধারণাই ছিলো না কোথায় যাচ্ছিলাম। এভাবে ভারতের মধ্যে কোথাও নদীর পাড়ে আম বাগান দেখে আমাদের নৌকা বহর থামলো রান্না, স্নান ও বাথরুম করার জন্য। সেই সুযোগে স্বাধীনভাবে ঘোরাঘুরি করলাম কয়েকজন সমবয়েসীর সাথে। তবে মনের মধ্যে ভীষণ সাহস পাচ্ছিলাম এই ভেবে, মৃত্যুর ভয় তো আর নেই। দাদুর কাছে কিছু টাকা পয়সা অবশিষ্ট ছিলো; তা দিয়ে স্থানীয় ছোট বাজার ও দোকান-পাট থেকে চাল-ডাল কিনে রান্না করে স্বস্তিতে খাওয়া-দাওয়া করলাম। এই ভাবে ক্রমাগত বহু দূর গ্রামের পর গ্রাম, নদী-খাল অতিক্রম করে একদিন বিকাল নাগাদ আমরা হাসনাবাদ শহরে পৌঁছালাম।

সত্যি কথা বলতে এর আগে আমি কখনও শহর বা গাড়ী তখনও দেখি নি। চারদিকে রিকশার প্যাঁপো শব্দ আর বাস-গাড়ীর শব্দ আর বাতাসে প্যাট্রোলের গন্ধে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লাম। মনে পড়ে শহরের একটু বাইরে রাস্তায় এসে যখন গাড়ী আসতে দেখছিলাম তখন ভয়ে রাস্তার নিচে নেমে যাচ্ছিলাম গাড়ীর ধাক্কা খাওয়ার ভয়ে।

এক রাত হাসনাবাদে কাটিয়ে পরের দিন খুব সকালে বারাসাতগামী কয়লা চালিত লোকাল ট্রেনে উঠতে চেষ্টা করলাম। কে কোথায় কী ভাবে ট্রেনে উঠেছিলো আজ আর মনে নেই। মনে নেই অনেক কিছুই। তবে জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো হৃদয়ে এখনও গেঁথে আছে কাটা দাগের মতো; কীভাবে তা ভোলা যায়! শৈশবের স্মৃতিশক্তি এখনকার চেয়ে যে শতগুণে ধারালো ছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রয়োজনে পরিবারের কারও সামান্যতম সহযোগিতা পেলে আজ ভিন্ন জায়গায় আমার অবস্থান হতো, একথা সত্যিকার অর্থেই বলা যায়।

হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম ট্রেনের দুই বগির মাঝখানে ধাক্কা লাগা লোহার মোটা দণ্ডের মতো বস্তুর উপর অনেকের সাথে। জীবনে ট্রেনও এই প্রথম বার দেখছি। কোন ধারণা ছিলো না। ট্রেনের কোন কম্পার্টমেন্টই খালি ছিলো না। দরজার পা দানিতে ঝুলছিলো শত শত পূর্ব বাংলার শরনার্থীরা। আমি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। হঠাৎ দেখি দাদু দীপ দীপ বলে আমাকে ডাকতে ডাকতে খুঁজছে! আমাকে ওখান থেকে নিয়ে জোর করে একটা জিনিসের মতো একটা লোকে ঠাসা কামরায় আমাকে ঢুকিয়ে দিলো। আর নিজে ঝোলার মতো করে দরজায় হ্যাণ্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। এখন ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। হয়তো সেদিন মারা পড়তাম ট্রেনের নিচে। কারণ পথেঘাটে তখন শুধু জয় বাংলার লোক মারা পড়ছিলো। ট্রেন কতৃপক্ষের কোন দায়িত্বই সেদিন ছিলো না। বেশ দেরি করে ট্রেন ছাড়লো। এক সময় বারাসাত এসে ট্রেন থামলো। আমরা নেমে নোংরা স্টেশনে জিনিসপত্র নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মনে আছে, তখন বৃষ্টি পড়ছিলো। (চলবে)


লেখক পরিচিতি

দীপক রায় – পূর্ণ নাম: দীপক কুমার রায়। জন্ম এস এস সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ৭ই জানুয়ারী, ১৯৬৩। বৃহত্তর খুলনার অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় মালগাজী গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় শ্রী ধনঞ্জয় রায় এবং মা শ্রীমতি অমলা রায়। মোংলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার দৌলপুরে সরকারী ব্রজলাল কলেজ থেকে যথাক্রমে এস এস সি এবং এইচ এস সি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।

চাকরি জীবন শুরু ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর, ঢাকায় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার একটা স্কুলে সিনিয়র ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার হিসাবে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ওই চাকরি থেকে ইস্তাফা দিয়ে বর্তমান পর্যন্ত স্বনিযুক্ত প্রশিক্ষক হিসাবে বিদেশী শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা ভাষার শিক্ষাদানের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। এক ছেলেও এক মেয়ের বাবা। ছেলে সুদীপ্ত রায় ঢাকার একটি বৃহত্তর বেসরকারী হাসপাতালে রেজিস্ট্রার ডাক্তার হিসাবে কর্মরত। মেয়ে শর্মিষ্ঠা রায় পরিবেশ বিজ্ঞানে সম্মান সহ সম্প্রতি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিয়েছে।

বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতে গভীর ব‍্যুৎপত্তি ও অনুরাগসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী দীপক রায়। তাই কাজের ফাঁকে নিজের সন্তুষ্টির জন্য লেখা-লেখি নিয়ে সময় পার করেন। ফেসবুকে জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে কবিতা লিখে থাকেন প্রতিদিনই, নিয়মিত। গান শোনা তাঁর অন্যতম প্রধান শখ। বিশেষতঃ রাগ প্রধান গান – এ উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ব্যপক আগ্রহ। যখনই অবসর পান গান শুনে সময় কাটানোই তার নিয়মিত অভ্যাস।