দীপক রায় – আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ৫

আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ৫

– দীপক রায়

সাধারণ নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু এলেন আমাদের অবহেলিত অঞ্চল মোংলায়। এর আগে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছিলাম, আর সাদাকালো ছবি দেখেছিলাম লিফলেট আর পোস্টারে। সাথে নৌকার ছবি। আজ আর মনে নেই কীভাবে খবরটা পেয়েছিলাম। আমাদের অঞ্চলে শেখ মুজিবুর না বলে লোকেরা বলতো মুজিবর। ছুটলাম এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা ধরে মোংলার দিকে। মামাতো ভাই আমার ‘ইন্দ্রনাথ’ মুকুলের সাথে। এক পর্যায়ে প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে হাত ধরাধরি করে চলে এলাম দু’জনে ১০ নম্বর জেটির কাছে। হঠাৎ দেখলাম জেটির রাস্তা থেকে বেরিয়ে আসছেন এক মাথা উঁচু মুজিব কোট আর চশমা পরা একজন মানুষ। আমি তাঁর দিকে আঙুল তুলে মুকুলকে বললাম, ওই যে! কারো ছবি দেখে আসল মমানুষকে চিনতে পারা আমার একটা গুণ বলতে পারি। তখন সেখানে পা রাখার জায়গা ছিলো না। পার্টির কর্মীরা তাঁর সামনের লোক সরিয়ে দিয়ে তাঁর যাওয়ার পথ তৈরি করছিলো। দেখলাম তিনি হঠাৎ নিজের দু’হাত দিয়ে লোকদের সরিয়ে দিয়ে সামনে এগোতে লাগলেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! তাঁর মধ্যে তখন এক বলিষ্ঠ উত্তেজিত ভাব লক্ষ্য করেছিলাম। এভাবে তিনি ভীড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে মোংলা পোর্ট খেলার মাঠে তৈরি বক্তৃতা মঞ্চে গিয়ে উঠলেন। তাঁর গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজ আর বক্তৃতায় মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলো। এক পর্যায়ে তিনি সবার কাছে ভোট চাইলেন। তিনি প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী কুবের চন্দ্র বিশ্বাস আর জাতীয় পরিষদের প্রার্থী সেখ লুৎফর রহমানের কাঁধে হাত রেখে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “এঁদের ভোট দিলে সে ভোট আমি পাবো।”

মালগাজী প্রাইমারী স্কুল শেষ করলাম। হাই স্কুলে ভর্তি হতে হবে। পছন্দের স্কুল সেন্ট পলস্ হাই স্কুল। তবে ওখানে ভর্তি আর টিউশন ফীস্ এর কথা চিন্তা করে আমার মত ছেলের সাহস হলো না। মামাতো ভাই গকুলের সাথে অভিভাবক দিবসে গিয়ে স্কুলের যে জাকজমকপূর্ণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, তাতে মনের মধ্যে একটা বড় আশা জেগেছিলো ওই স্কুলে পড়াশুনা করার।

প্রথমে টাটিবুনিয়া স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে প্রায় এক মাস ক্লাস করেছিলাম ভর্তি ছাড়া। মনে আছে ভর্তি না হলেও শিক্ষকরা আমার দিকে বেশ নজর দিতেন। বিশেষ করে ইংরেজীর শিক্ষক দিলীপ বাবু। তবে সেন্ট পলসের ক্লাস রুম দেখা এই সুবোধ বালকের টাটিবুনিয়ার ছাগোলদের অবাধ বিচরণের স্থান ক্লাস রুম দেখে মোটেও পছন্দ হতো না। দীর্ঘ এক মাস ক্লাস করার ফলে ষষ্ঠ শ্রেণীর উপযোগী একজন ছাত্র হিসাবে অনেকের সাথে আমার ভালো পরিচয় হয়ে যায়। এদের মধ্যে ছিলো মিঠাখালীর নতুন মৌলভী সাহেবের (মালগাজী স্কুলের) ছেলে কবির, মৌখালীর সমর, মধু সহ কয়েক জন। আজ আর তাদের নাম মনে পড়ছে না। স্কুলের কৃষ্ণ বাবু তাঁর প্রভাব খাটিয়ে আমার জন্য এক সেট পুরানো বইয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন অর্ধেক দামে। কিন্তু মন বসলো না। মালগাজী স্কুলে যারা আমার সাথে পড়তো, তাদের বেশ কয়েক জন টাকা পয়সা ওয়ালা ছেলে মেয়ে তখন সেন্ট পলসে ভর্তি হয়ে ক্লাস করছে। আমি শুধু দূর থেকে তাদের স্কুলে যাওয়া আসা দেখতাম। তারা নতুন ছাতা, সুন্দর ইংলিশ প্যান্ট, ফ্রক আর স্যান্ডেল পরে সেন্ট পলস্ স্কুলে যেতো। শুধু ভাবতাম আমিতো তাদের চেয়ে ভালো করে প্রথম স্থান অধিকার করে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করেছি। তাহলে কেনো আমি ওই স্কুলে পড়তে পারবো না!

মাকে বললাম মনের ইচ্ছাটা। মা বললো চল, ফ্রান্সিস বাবুর কাছে গিয়ে দেখি। ফ্রান্সিস বাবু সেন্ট পলস্ স্কুলের একজন শিক্ষক; আর আমাদের পারিবারিক বন্ধুও। উনি পরামর্শ দিলেন স্কুলের অন্য একজন শিক্ষক অমর পিটার বাবুর কাছে যেতে। ওনারা দু’জনই আমার গ্রামের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। এক সকালে ছুটির দিন মার সঙ্গে অমর পিটার বাবুর বাড়ীতে গেলাম। গ্রামে আমরা পারিবারিক ভাবে সবার কাছে ভালো পরিচিত ছিলাম। মাকে সবাই চিনতেন। বাবা মারা যাবার পর অর্নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও পরিবারের সম্মান সব দিন উজ্জ্বল ছিলো। স্যার আমার পড়াশুনার কথা শুনে খুশী হলেন আর স্কুলে এসে তখনকার ইতালীয় প্রধান শিক্ষক ফা: পিও মাত্তেভির সংগে দেখা করতে বললেন। তিনি এটাও বলেছিলেন যে এ ব্যাপারে তিনি ফাদারকে বলে রাখবেন।

নির্দিষ্ট দিনে সকাল বেলা আমি ও আমার মা অমর পিটার স্যারের সময় অনুযায়ী বেশ সাহস নিয়ে স্কুলে ঢুকলাম। বিশাল লম্বা দ্বিতল ভবন। ইতালীয় স্টাইলের ছাদ (টিনের চাল)। গেইট দিয়ে ঢুকেই বাঁ দিকে স্কুল বিল্ডিং। আগে অন্তত: দু’বার ঢুকেছিলাম অভিভাবক দিবসে গেস্ট হিসাবে। দোতলায় হল রুমে ঐতিহাসিক নাটকের অভিনয় (তরবারী যুদ্ধ সহ) ও সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হাতে জিলাপী পাওয়ার বিষয়টা মনে ছিলো। নিচ তলায় বারান্দায় পা দিলেই বাঁ হাতে প্রথম রুমটায় জানালার পাশে বসতেন হেড মাস্টার ফাদার পিও মাত্তেভি। আমরা বারান্দার একটা পিলারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম অমর পিটার স্যারের অপেক্ষায়। তিনি এসেই ভিতরে গিয়ে প্রায় সংগে সংগে বেরিয়ে এসে আমাদের নিয়ে আবার ভিতরে ঢুকলেন। স্যার আমার কাছে এসে ফিস ফিস অথচ শক্ত কন্ঠে বললেন, প্রণাম করো ওনাকে। ফাদার পিওকে আগে দেখেছি স্কুলের অনুষ্ঠানে, দু্’একবার রাস্তায়ও। হাসি মাখা মিষ্টি মুখ, তার মধ্যে একটা কড়া ভাব। আমি ও মা ওনাকে প্রণাম করলাম। উনি আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, “ও দেখো, যদি তুমি পরাসুনা ভালো করবে, তাহলে তোমাকে ফ্রী করতে পারবো।” এর পর অন্য দু’একজন ছেলের সাথে অমর পিটার স্যার আমার একটা লিখিত পরীক্ষা নিলেন ওই রুমেই বড় টেবিলে (শিক্ষকদের মিটিং টেবিল) বসিয়ে।

অল্প সময়ের মধ্যেই ফাদার আমার খাতা হাতে নিয়ে দেখলেন আর স্যারকে কিছু বললেন। অমর পিটার স্যার মার সংগে কথা বললেন আর দশ টাকা নিয়ে আমাকে পরের দিন পাঠাতে বললেন ভর্তির জন্য। আমার মনে পড়ে প্রশ্ন আমার জন্য খুব সহজ ছিলো। সবই ক্লাস ফাইভের বই থেকে। তাই অতি অল্প সময়ে সবার আগেই আমি শেষ করি। তখন রিভিশনের কোন দরকার বোধ করতাম না। আমি এত খুশী হয়েছিলাম যে তা আজ আর বলে বুঝাতে পারবো না।

সব চেয়ে মজার ব্যাপারটা ঘটেছিলো ভর্তির দিন। আমি ১০ টাকার একটা নোট নিয়ে এসে সাত সকালে অফিস রুমের সামনে হাজির। যথারীতি দাঁড়িয়ে আছি থামটার কাছে। লাজুক ছিলাম অসম্ভব রকমের। দেখলাম ফাদার পিও জানালার পাশে বসে ছোট্ট একটা মেশিনে টাইপ করছেন এক মনে। মনে হলো একবারও তাকালেন না আমার দিকে। আমি কেনো জানি ভাবছিলাম টাকাটা অমর পিটার স্যারের হাত দিয়ে ফাদারকে দেবো। স্যারের জন্য অপেক্ষা করে করে না পেয়ে খানিক পরে স্কুল থেকে বের হয়ে বাড়ীর দিকে হাঁটা দিলাম। আমি আজও এ প্রশ্নের উত্তর পাই নি, কেনো সে দিন ফাদারের কাছে টাকাটা দিতে চাই নি। প্রভাত চকিদারের বাড়ীর উপর দিয়ে শুকনা বিলে নেমে বল্লা গাছের বাগানের ভিতর দিয়ে অন্ধকার পথ পার হয়ে আমাদের বাড়ীর দিকে যাওয়ার জন্য তখন শর্টকাট পথ ছিলো। বল্লা বাগানের ভিতর এসে হঠাৎ মনে হলো, কেন আমি ভর্তি না হয়ে বাড়ী ফিরছি? জীবনে ভর্তি কথাটা শুধু থিওরিটিক্যালী জানতাম, প্রাক্টিক্যাল কোন অভিজ্ঞতা ছিলো না। মন পরিবর্তন করে ফিরে চললাম স্কুলের দিকে। স্কুলে ঢুকে অফিসের সামনে আসতেই ফাদার পিও হঠাৎ করে বাইরে এসেই আমার পেটে বড় করে চিমটি কেটে ধরে আমার হাত থেকে টাকাটা কেড়ে নিলেন। মুখে সেই মৃদু গ্রেট হাসি! ভিতরে গিয়ে একটা কাগজে কিছু লিখে জানালা দিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন, আর বাড়ী যেতে বললেন। তখন ছিলো স্কুল বন্ধের সময়, সম্ভবত: ডিসেম্বর মাস। বাড়ী ফিরে কী কী বলেছিলাম মাকে, সে সব কথা আর কিছুই মনে নেই। তবে মনে মনে সেন্ট পলসের ছাত্র হওয়ায় প্রচন্ড এক্সাইটেড ছিলাম। সত্যি কথা বলতে ক্লাস শুরু না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাসই হচ্ছিলো না আমি সেন্ট পলস্ হাই স্কুলেন ছাত্র হয়েছি। (চলবে)


লেখক পরিচিতি

দীপক রায় – পূর্ণ নাম: দীপক কুমার রায়। জন্ম এস এস সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ৭ই জানুয়ারী, ১৯৬৩। বৃহত্তর খুলনার অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় মালগাজী গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় শ্রী ধনঞ্জয় রায় এবং মা শ্রীমতি অমলা রায়। মোংলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার দৌলপুরে সরকারী ব্রজলাল কলেজ থেকে যথাক্রমে এস এস সি এবং এইচ এস সি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।

চাকরি জীবন শুরু ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর, ঢাকায় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার একটা স্কুলে সিনিয়র ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার হিসাবে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ওই চাকরি থেকে ইস্তাফা দিয়ে বর্তমান পর্যন্ত স্বনিযুক্ত প্রশিক্ষক হিসাবে বিদেশী শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা ভাষার শিক্ষাদানের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। এক ছেলেও এক মেয়ের বাবা। ছেলে সুদীপ্ত রায় ঢাকার একটি বৃহত্তর বেসরকারী হাসপাতালে রেজিস্ট্রার ডাক্তার হিসাবে কর্মরত। মেয়ে শর্মিষ্ঠা রায় পরিবেশ বিজ্ঞানে সম্মান সহ সম্প্রতি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিয়েছে।

বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতে গভীর ব‍্যুৎপত্তি ও অনুরাগসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী দীপক রায়। তাই কাজের ফাঁকে নিজের সন্তুষ্টির জন্য লেখা-লেখি নিয়ে সময় পার করেন। ফেসবুকে জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে কবিতা লিখে থাকেন প্রতিদিনই, নিয়মিত। গান শোনা তাঁর অন্যতম প্রধান শখ। বিশেষতঃ রাগ প্রধান গান – এ উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ব্যপক আগ্রহ। যখনই অবসর পান গান শুনে সময় কাটানোই তার নিয়মিত অভ্যাস।