শুক্লা বোস – কবিতাগুচ্ছ

পল্লী মেয়ে

– শুক্লা বোস

চলছে দেখ পল্লীমেয়ে গাঁয়ের পথটি বেয়ে,
হালকা চালে কোমর দোলে রূপের ধারায় নেয়ে।
রূপ-গরবে গরবিনী চলছে হেলে-দুলে,
রূপ দেখে তার নয়ন জুড়ায় – রূপে ভুবন ভোলে।
অঙ্গ বেড়ে ডুরে শাড়ি – স্নিগ্ধ ছায়া মুখে,
মাটির ধরার মাটির মেয়ে – চলছে কেমন সুখে।
স্পর্শে যে তার পদ্ম ফোঁটে সবুজ বিলের জলে,
বর্ণে-গন্ধে-রূপে-রসে হৃদয় যে তার দোলে।
গভীর কালো চোখদুটিতে নেই বিদ্যুৎ ছটা,
অতল দীঘির কোলে যেন ঘন মেঘের ঘটা।
ইচ্ছে করে ডুবতে সেথায় অতল জলের তলে,
কালো চোখের কাজল মায়ায় পরাণখানি দোলে।
উথাল-পাথাল হাওয়ায় দোলে কালো কেশের রাশি,
মেঘের উপর মেঘ যেন রে যায় যে হাওয়ায় ভাসি।
শরৎকালের শিশির ধোয়া মুখটা ঢল ঢলে,
পদ্মদীঘির পদ্ম যেন পাঁপড়িগুলো মেলে।
কণ্ঠে যে তার বীনা বাজে তরঙ্গহিল্লোলে
বাঁশির সুরে কয় যে কথা, কল্যাণী ওই মেয়ে।
বুকের মাঝে ভালোবাসা উঠিছে গুঞ্জরি,
হৃদ-কাননে ফোঁটে যেন মাধবী- মঞ্জরী।
গৌরবরণ পল্লীবালার গায়ের বরণ সোনা,
রূপের ছটায় আলো ভূবন, দোলে জগৎখানা।
রূপের ভারে নুইয়ে পড়ে কাশের ফুলের ডাটা,
হেলিয়ে দুলিয়ে পড়ে সেই না রূপের ছটা।
চলতে পথে পল্লীবালা এদিক-ওদিক চায়,
সবুজ বরণ ঘাসগুলি যে লুটিয়ে পড়ে পায়।
চিরন্তনী পল্লীমেয়ের রূপের বাখান যত,
যায়না লেখা কালি দিয়ে, বলবো কত শত!

সংঘাত

– শুক্লা বোস

পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে এটা যেমন জানি,
পুরোনো যা সব ভালো নয় এটাও তেমন মানি।
পুরোনো সেই মানুষগুলোর তিন-চারটে বিয়ে,
যখন যাকে ভালো লাগে থাকতো তাকে নিয়ে।
বাকি সকল বৌগুলো যে গোয়াল ঘরের গরু,
চিকন চালটা যেমন স্বাদু তেমনি বেজায় সরু।
বিয়ে বহির্ভুত সম্পর্ক ছিলো জনে জনে,
অসহায়া, অশিক্ষিতা সবটা নিতো মেনে।
কিষাণেরা একটিবার-ই জমিতে ধান পোতে,
পুরুষ বাবুর নেই কোন কাজ, আরামেতে মাতে।
ক্ষেতের চাল আর খালের মাছে স্ফীত উদর,
কাজের বালাই নেইকো কোন, বাবুয়ানার বাহার!
বিবর্তনের ধারায় এখন পাল্টে গেছে যুগ,
পুরোনোরা তড়পে মরে নেইকো মনে সুখ।

নারী এখন সু-শিক্ষিতা, ভালো মন্দ বোঝে,
মন্দটারে ছুড়ে ফেলে ভালোটারে খোঁজে।
সন্তানেরই সুশিক্ষাতে নারী আগুয়ান,
শিক্ষামন্ত্রী নিজে নারী – শিক্ষায় বেগবান।
পোশাক তরে নেইকো নারীর এখন কোন শোক,
পাশ্চাত্যের ধারা এসে পাল্টে গেল ঝোঁক।
তবুও সবাই পরে জামা এমন কিন্তু নয়,
বহু নারী এই যুগেতে শাড়িটারে চায়।
আগের যুগে ফ্লাট ছিলোনা থাকলে নারী যেত,
স্বামী নামক অত্যাচারির থেকে মুক্তি পেতো।
নারী শুধু নয় ঘরণী সে ও যে মানুষ,
আগের যুগের মানুষগুলোর ছিলোনা সেই হুশ।
খাঁচায় পুরে নারীকে আর যাবেনা পোষ মানা,
অত্যাচারী পুরুষ মুখে ঘষবে নারী ঝামা।
আজকে নিজের অধিকারে নারী সচেতন,
হৃদয় দিয়ে নারীকে তাই জানাই স্বাগতম!!

বিট্টু ও ছোট্টু

– শুক্লা বোস

(সুন্দরবন অঞ্চলে নদীর চরে পলি জমে। নদীতীরের ছেলেরা ভাঁটার সময়ে সড়াৎ সড়াৎ খেলা খেলে। তার-ই আলোকে রচিত কবিতা)

“শোন না ওরে ছোট্টু!”
“ডাকছো দাদা বিট্টু?”
চল না রে ভাই, ঘুরে আসি নদীর চরেতে,
“সড়াৎ সড়াৎ” খেলবো খেলা দারুন মজাতে।
নদীর চড়ায় জমলো পলি–কী সুন্দর পিছলা,
সড়াৎ খেয়ে পড়বো জলে, মজা বুঝিস না?

“দাদা! করছে কেমন ভয়!
মা যদি টের পায়?
কানটি ধরে চৌদ্দ পোয়ায় রাখবে দুজনারে,
দুপুর রোদে খাবি খাবো–ভাত জুটবে নারে!”

“কী বোকা তুই ওরে!
মা, টের পাবে কী করে?
বলবো মাকে খেলতে যাচ্ছি পুবের দিকের ‘ডরে’,
একসাথে মা, স্নানটি সেরে ফিরবো তবে ঘরে।”

“দাদা, কাঁপছে পরাণ ডরে, (ভয়ে)
‘কামট’ যদি ধরে?
ঠ্যাং কামড়ে অতল জলে নিয়ে যাবে শেষে,
জলের তলায় মারবে জানিস, উঠবো না আর ভেসে!”

“ভয় পাসনি ভাই!
‘কামট’ কোথায় নাই?
দেখলে কামট একটা ছুটে আসবো ফিরে ঘরে,
দেখবো তখন কামট মোদের কেমন করে মারে?
বুদ্ধি তো নেই ঘটে,
যমজ হলেও পাঁচ মিনিটের বড় আমি বটে!!”

(কবিতায় কয়েকটা আঞ্চলিক শব্দ আছে। যেমন, চৌদ্দ পোয়া – দু-কান ধরে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকা; ডর – বিল, কামট – হাঙ্গর।)


কবি পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।

ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।

বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।