দীপক রায় – আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ৩

আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ৩

– দীপক রায়

ঠিক কত সালে আমাদের গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলাম তা আজ মনে নেই। তবে মনে আছে স্কুল ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে শিশু শ্রেণী, ১ম শ্রণী ও ২য় শ্রেণীর ক্লাস একটা বড় রুমে ছিলো। রুমেরর দুই পাশের চৌকাঠের নীচ দিয়ে গ্রামের ছাগোলগুলো তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে স্কুল চলাকালীন সময় ছাড়া বাকী সময়গুলোতে প্রবেশ করতো, বিশ্রাম করতো আর প্রাকৃতিক কর্ম দুটিও সমাধা করতো। এ ক্লাসের “ব্লাক” বোর্ডটিতে তৈরীর পর থেকে কোনো রং জোটে নি। শিরিশ কাঠের প্রাকৃতিক রঙের উপর অনেক কসরত করেই মৌলোভী সাহেবচক দিয়ে লিখতেন। সাধারণত: তিনিই এ তিনটি ক্লাসের পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন। তাঁর চিবুকে এক গোছা সাদা-কালো গোটী বেয়ার্ড ছিলো। “পিটিয়ে পিঠের খাল তুলে নেবো” – পড়া না পারলে বা দুষ্টুমি করলে তিনি এভাবেই শাসাতেন। ক্লাসে আসতেন তিনি পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি পরে। একটা ছাতা থাকতো তাঁর নিত্য সঙ্গী। সেই চাঁদপাই থকে বর্ষাকালে কাদা পথ পাড়ি দিয়ে ঠিক সময় তিনি স্কুলে আসতেন। মনযোগী, ঠান্ডা আর শিক্ষকদের বিবেচনায় “ভাল ছাত্র” হিসাবে তিনি আমাকে খুব আদর করতেন। এক বার ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি স্কুলের কোনো কাজে আমাকে নিয়ে হলদিবুনিয়া প্রাইমারী স্কুলে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে দুপুরের রোদে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি তাঁর পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটি টাকা(কাগজের নোট) বের করে আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, ওই দোকান থেকে বিস্কুট কিনে খাও। তখনকার দিনে নাবিস্কো বিস্কুট ছিলো আমার প্রিয়। আর সে কালের এক টাকা মানে এখন কম করে ৫০ টাকা। মনে পড়ে আমি দুই আনা দিয়ে আধা ছটাক বিস্কুট কিনে ওনাকে চৌদ্দ আনা ফেরত দিতেই উনি বলেছিলেন, আমিতো তোমাকে পুরাটাই খরচ করতে বলেছি। উনি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে খাবার কিনতে পাঠিয়েছিলেন। আমি খুব লাজুক ছিলাম, তাই হয়তো আমাকে দিয়ে কেনাতে চেয়েছিলেন। প্রকৃত শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের এভাবেই শিখান। আজ লিখতে গিয়ে আমার চোখে জল এসে গেলো।

ঢাকা থেকে গ্রামে গেলে মামাতো ভাই মুকুল চন্দ্রকে (আমার ছোটো বেলার ইন্দ্র নাথ) নিয়ে প্রায়ই এলাকার বিভিন্ন গ্রাম ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। মাকোড়ঢোন, চাঁদপাই, মৌখালী, মিঠাখালী, জয়খাঁ ইত্যাদি গ্রাম ঘোরার সময় একবার চাঁদপাই মৌলোভী সাহেবের বাড়ীর খোঁজ করে ওনার ছেলেকে পাই, তাঁর খোঁজ খবর নিতে গিয়ে জেনেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর গত হওয়ার কথা।

মালগাজী স্কুলের অন্য দু’জন শিক্ষক ছিলেন আমাদের গ্রামের প্রাণ প্রিয় ঠাকুর মাষ্টার মশায় আর প্রধান শিক্ষক হলদিবুনিয়ার যতীন বাবু।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তারকৃত বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তির দাবীতে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সম্ভবত: ২১শে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষ্যে। স্কুলে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্যে আমরা লাইন করে স্কুলের ছোট মাঠে দাঁড়িয়েছি। এমন সময় পাঞ্জাবী-পাজামা পরা মাথায় ভারি ও খানিকটা বড় চুলওয়ালা একজন অচেনা লোক আমাদের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে কঠিন ভাষায় বক্তৃতা দিলেন। তাঁর সাথে আরও দু’চার জন যুবক ছিলো।আমরা অবাক হয়ে তাঁর অল্প সময়ের বক্তৃতাটা শুনলাম। এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে আগে আমি শুনি নি। তিনি আমাদের টাটিবুনিয়া স্কুলে মিটিংএ যেতে বলে গেলেন। তিনি তাঁর লম্বা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে এক তাড়া টাকা বের করলেন, সব ছিলো একটাকার নোট। সেখান থেকে তিনি তিনটা ১ টাকার নোট দিলেন হেডমাস্টারের কাছে কালো পতাকা বানানোর জন্যে। তিনি যেমন তাড়াতাড়ি এসেছিলেন, তেমন তাড়াতাড়ি চলে গেলেন সাথের লোকদের নিয়ে। তিনি ছিলেন রামপালের গাজী আব্দুল জলিল! পরে তাঁর সংগ্রামী পরিচয় পেয়েছিলাম! তাঁকে আগে কখনও দেখি নি। সে সময়ে কেন জানি না মনে হয়েছিলো এক দিন তাঁর ছবি বইয়ের পাতায় ছাপা হবে। এর পর ‘৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের সময় তাঁকে মোংলায় দেখেছি। এর অনেক বছর পর ১৯৭৯/৮০ সালের দিকে ঢাকার মন্ত্রীপাড়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সাক্ষাৎ প্রার্থী হিসাবে দেখে অবাক হয়েছিলাম। তখন তাঁর মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে, সেই তেজস্বীতা আর নেই, দৈহিক উচ্চতা যেন খানিকটা কম (কারণ আমি তখন কৈশরের শেষ সীমায় বেশ লম্বা), মুখে মৃদু হাসি নিয়ে আমার সালামের জবাব দিয়েছিলেন। বি এন পি তখন ক্ষমতায়! তাঁকে দেখে অনেকটাই কষ্ট পেয়েছিলাম। মোস্তফিজুর রহমান তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্বে। দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য একটা সিগনেচারের জন্য আমি তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। যাই হোক, আমরা নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে স্কুল থেকে টাটিবুনিয়া হাই স্কুলে যাই। ওখানে অনেক গুলো মাইক লাগিয়ে বাইরে থেকে আসা ছাত্র নেতারা বক্তৃতা করেছিলো। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম বারের মত জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে অবাক হয়েছিলাম। বক্তারা অধিকাংশ ছিলেন শহরের কলেজে পড়ুয়া।আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, শুনছিলাম। সেই থেকে একটা অভ্যাস আমার মধ্যে তৈরী হয়। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মিটিং এ বক্তৃতা শুনতে। ঢাকায় এসে এটা পরিপক্বতা লাভ করে বয়েসের সাথে সাথে। কলা ভবনের সামনে বটতলায় ছাত্র নেতাদের বক্তৃতা শোনার পাশাপাশি বাইতুল মোকাররমের সামনে সময় পেলে হাজির হতাম একাকীই। শুনতাম মার্কেটের বারান্দায় পিলার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। সেদিন বিশেষ করে টাটিবুনিয়া স্কুলের দশম শ্রেণীর অনেক কুচি দেয়া ফ্রক পরা একজন মেয়ের সাহসী বক্তৃতার কথা আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে। ওই সময় টাটিবুনিয়া স্কুলে অনেক ছাত্র-ছাত্রী ছিলো আর তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বেশ জোরালো ভাবে চলতো। মিটিং থেকে ফেরার পথে মালগাজী হাট আর কাচারি বাড়ী এলাকায় যে দৃশ্য দেখেছিলাম তা কোন দিন ভোলার নয়। সমস্ত রাস্তা আর মাঠ জুড়ে ছিলো কাগজ আর কাগজ। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে শত শত তরুন মোংলার দিক থেকে এসে মালগাজীর কাছারি বাড়ীর সামনে দিয়ে যখন টাটিবুনিয়া স্কুলের মিটিংএ যাচ্ছিলো, তখন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তারা সরকারী কাচারি অফিস আক্রমণ করে ভাঙচুর চালায়, অফিসেনর সব কাগজ পত্র হাতে হাতে নিয়ে সমস্ত এলাকায় ছড়িয়ে দেয়। অনেক দিন ধরে সে সব দলিল পত্র পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যায়। এ এলাকায় ওটাই ছিলো পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে দৃশ্যমান প্রথম কার্যকরী প্রতিবাদ। (চলবে)


লেখক পরিচিতি

দীপক রায় – পূর্ণ নাম: দীপক কুমার রায়। জন্ম এস এস সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ৭ই জানুয়ারী, ১৯৬৩। বৃহত্তর খুলনার অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় মালগাজী গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় শ্রী ধনঞ্জয় রায় এবং মা শ্রীমতি অমলা রায়। মোংলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার দৌলপুরে সরকারী ব্রজলাল কলেজ থেকে যথাক্রমে এস এস সি এবং এইচ এস সি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।

চাকরি জীবন শুরু ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর, ঢাকায় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার একটা স্কুলে সিনিয়র ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার হিসাবে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ওই চাকরি থেকে ইস্তাফা দিয়ে বর্তমান পর্যন্ত স্বনিযুক্ত প্রশিক্ষক হিসাবে বিদেশী শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা ভাষার শিক্ষাদানের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। এক ছেলেও এক মেয়ের বাবা। ছেলে সুদীপ্ত রায় ঢাকার একটি বৃহত্তর বেসরকারী হাসপাতালে রেজিস্ট্রার ডাক্তার হিসাবে কর্মরত। মেয়ে শর্মিষ্ঠা রায় পরিবেশ বিজ্ঞানে সম্মান সহ সম্প্রতি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিয়েছে।

বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতে গভীর ব‍্যুৎপত্তি ও অনুরাগসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী দীপক রায়। তাই কাজের ফাঁকে নিজের সন্তুষ্টির জন্য লেখা-লেখি নিয়ে সময় পার করেন। ফেসবুকে জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে কবিতা লিখে থাকেন প্রতিদিনই, নিয়মিত। গান শোনা তাঁর অন্যতম প্রধান শখ। বিশেষতঃ রাগ প্রধান গান – এ উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ব্যপক আগ্রহ। যখনই অবসর পান গান শুনে সময় কাটানোই তার নিয়মিত অভ্যাস।