আমার ছোটবেলা ও স্কুল-জীবন – ২
– দীপক রায়
খুব ছোট বেলায় একটা কথা ভাবতাম। তখন বয়েস কত হবে, তা মনে নেই। ভাবতাম, মালগাজী আর হলদিবুনিয়া সমস্ত দুনিয়ার মধ্যে দু’টি গ্রাম। আমাদের বাড়ীর সামনে যে ছোট্ট খালটি ছিলো তার দক্ষিণ পারের অংশটা হলদিবুনিয়ার। হলদিবুনিয়া আমার মামাবাড়ী। এর বাইরে অন্য কোন তৃতীয় প্রধান গ্রামের অস্তিত্ব আমার মনের মধ্যে ছিলো না। মালগাজীর পিছনে দূরের অস্পষ্ট যে সবুজ বেষ্টনী দেখা যেতো, তা ছিলো সাতঘরিয়া, মউখালী আর ব্রাহ্মণ মাঠ। আমার ধারণা ছিলো এসবই মালগাজীর অন্তর্গত। সম্ভবত: ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের আগে বা পরে রামপাল-মোংলা এলাকায় একটা বড় হিন্দু নিধন দাঙ্গা হয়। প্রয়ই শুনতাম ‘পোট'(পোর্ট) গরম। এক শীতের রাতে হঠাৎ আমাদের ঘুম থেকে তোলা হোলো। সবার দৃষ্টি পশ্চিম দিকে, পোর্টের দিকে। এখনও স্মৃতিতে স্পষ্ট – পশ্চিম আকাশের আগুনের সেই লাল-সোনালী ভয়াবহ দৃশ্য। শুনেছিলাম অনেকগুলো বাড়ীতে দাঙ্গা কারীরা আগুন দিয়েছে, কয়েকটা সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করে তাদের সোনাদানা টাকা পয়সা সব লুট করে নিয়ে গিয়েছে। একটু একটু মনে পড়ে, ঘটনার পর দিন খুব ভোর বেলায় আমরা বাড়ী ছেড়ে শুকনা বিলের মধ্য দিয়ে শত শত মানুষের সাথে পুব দিকে রওনা হই। বিলের মধ্যদিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে মাঠে পড়ে থাকা কিছু স্যান্ডেল, কাপড় ইত্যাদি। এটা ছিলো আমার বাড়ী থেকে প্রথম বের হওয়ার অভিজ্ঞতা! মনে আছে, আমার মনে তেমন ভয় ছিল না। নতুন যাত্রায় একটা উত্তেজনা কাজ করছিলো অবুঝ মনে। প্রথমে সাত ঘরিয়ার একটা বাড়ীর দরজায় গেলাম। ঘরের দরজা বন্ধ ছিলো। ওই সময় আমার সাথে থাকা আমার পরিবারের কারো কথা স্মরণে নেই। আমরা তখন বশিরখন্ড নামে একটা গ্রামে গেলাম। নামটা অজানা, নতুন। একটা টিনের ঘর, বড় পুকুর আর বাগানওয়ালা বাড়ীর উঠানে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও বাড়ীতেও অনেক অনেক মানুষের ভীড় ছিলো। সময়টা ছিলো সম্ভবত: শীতের শেষ দিকে। ওবাড়ীতে আশ্রয়ের ব্যবস্থা হলো না। এর পর গড়ের পুকুর আর বিল পাড়ি দিয়ে মউখালী একটা বাড়ীতে আশ্রয় মিললো। ঘটনা গুলো ধারাবাহিক ভাবে আমার মনে নেই। শুধু সিনেমার অতীত দৃশ্যের মতো এক এক ঝলক মনের মধ্যে হঠাৎ উঁকি দেয়। দিনটা কীভাবে কেটেছিল আজ আর তা মনে নেই। পরের দিন সকালে হঠাৎ ছুটোছুটি। দাঙ্গাকারীরা দলবদ্ধ হয়ে ব্রাহ্মণ মাঠের শেষ অব্দি পৌঁছেছে। এদিকে মৌখালী, টাটিবুনিয়া, দত্তের মেঠের লোকরা একত্রে তাদের রুখে দিয়েছে।
শুনেছিলাম ওখানে সামনা সামনি সংঘর্ষে কিছু লোক মারা গিয়েছিলো। বিহারীদের প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ইউনুস আলী সাহেব। তিনি বন্দুক নিয়ে এসেছিলেন আর গোলাগুলির ঘটনাও সেদিন ঘটেছিলো। এ ঘটনা যখন ঘটছিলো তখন মৌখালীর পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে বিলের মধ্য দিয়ে আমরা ছুটতে থাকি। এক পর্যায়ে ছোট্ট আমি, আমার চেয়ে কিছু বড় আমার মামাতো ভাই গোকুল আর সদ্যবিবাহিতা মামাতো দিদি –এ তিন জন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। ঝর্ণাদির সাথে একটা সুটকেস ছিলো। সেটা সে নিজেই বইছিলো, আমি নিজেই চলতে পারছিলাম না, মনে পড়ে শুধু দৌড়াচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে একটা বাঁশের চারের কাছে আসলাম, পার হতে হবে। একজন দুষ্টো লোক আমাকে পার করে দিলো, গোকুলকেও। এর পর দিদির সুটকেস। লোকটা দিদির হাত ধরে পার করে দিতে চাইলো। ঝর্ণাদির অনেক সাহস ছিলো। সে লোকটির সাহায্য নিতে অস্বীকার করলো।
মনে পড়ে সেদিন ছুটতে ছুটতে ঝর্ণাদির সাহস আর বুদ্ধিতে ভর করে সন্ধ্যায় মাদুরপাল্টা গ্রামে দিদির নতুন শ্বশুর বাড়ীর এক আত্মীয়ের বাড়ীতে আশ্রয় নেই। দুপুর রাতে বড় মামা পাগলের মতো খুঁজতে খুঁজতে সেখানে যায়। আমি হঠাৎ মামার কথা শুনে জেগে গিয়েছিলাম। মামা আমাদের সাথে কথা না বলে সেই রাতে আমাদের পরিবারের অন্যদের খোঁজে চলে যায়। পর দিন আমরা শনিরঝোরে মামার শ্বশুর বাড়ীতে যাই। পথে বিলের মধ্যে স্থানীয় হিন্দু বিদ্ধেষী লোকরা আমাদের পথ রোধ করে। দিদির শ্বশুর এসময় আমাদের সাথে মিলিত হন। তিনি খুব ভালো কথা বলতে পারতেন, অনেক প্রভাবশালী লোকদের চিনতেন। ওরা আমাদের ছেড়ে দেয়। আমরা শনিরঝোর পৌঁছি বিকালে। অন্য সবাই তখন নারকেল বাড়ী গ্রামে এক প্রভাবশালী ধনী মুসলমান পরিবারের আশ্রয়ে ছিলো। খবর পেয়ে পরিবারের অন্যান্যরা আমাদের কাছে শনিরঝোরে চলে আসে। ওখানে কয়েক দিন থাকার পর পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে বাড়ীর দিকে রওনা হই। পথে আরও অন্তত: একটা রাত বিলের মধ্যে একটা বাড়ীতে কাটাই। অবস্থাপন্ন হিন্দু বাড়ী। পরবর্তীতে চটের হাটে যাওয়া আসার পথে ওই বাড়ীটা দেখতাম, আর স্বপ্নের মতো অস্পস্ট মনের মধ্যে সে দিনের কথা ভেসে উঠতো!
এক পড়ন্ত দুপুর বেলায় সাত ঘরিয়ায় ঝর্ণাদির শ্বশুর বাড়ীর সামনে দিয়ে বাড়ীর দিকে যাই। পথের সেই মুহূর্তটা এখনও স্পষ্ট এক ঝলক! এর পর বাড়ী ফেরার কথা কিছুই মনে পড়ে না।
যারা এ জঘন্য কাজগুলো করেছিলো তারা পাকিস্তানের সেবক বিহারী। এদের সাথে যোগ দেয় কিছু স্থানীয় দুষ্টো লোক। এরা সব সময়ই সুযোগ পেলে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করতে পিছু পা হয় নি। এরা বিহারীদের সাথে পাকিস্তান প্রশাসনের মদদে হিন্দু প্রধান পুরো মোংলা এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে সে সময়। লুটতরাজ হত্যা নির্বিঘ্নে চললো কয়েক দিন ধরে। ওই ঘটনার পরপরই এ এলাকার বহু হিন্দু পরিবার তাদের ধন-সম্পত্তি জমি-জমা ফেলে ভারতে চলে চির তরে। আর তাদের সম্পত্তিকে তখন শত্রু-সম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করলো পাকিস্তান সরকার যা এখও ‘অর্পিত’ সম্পত্তি নামে একই ভাবে কার্যকর আছে। (চলবে)
লেখক পরিচিতি

দীপক রায় – পূর্ণ নাম: দীপক কুমার রায়। জন্ম এস এস সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ৭ই জানুয়ারী, ১৯৬৩। বৃহত্তর খুলনার অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় মালগাজী গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় শ্রী ধনঞ্জয় রায় এবং মা শ্রীমতি অমলা রায়। মোংলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার দৌলপুরে সরকারী ব্রজলাল কলেজ থেকে যথাক্রমে এস এস সি এবং এইচ এস সি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
চাকরি জীবন শুরু ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর, ঢাকায় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার একটা স্কুলে সিনিয়র ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার হিসাবে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ওই চাকরি থেকে ইস্তাফা দিয়ে বর্তমান পর্যন্ত স্বনিযুক্ত প্রশিক্ষক হিসাবে বিদেশী শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা ভাষার শিক্ষাদানের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। এক ছেলেও এক মেয়ের বাবা। ছেলে সুদীপ্ত রায় ঢাকার একটি বৃহত্তর বেসরকারী হাসপাতালে রেজিস্ট্রার ডাক্তার হিসাবে কর্মরত। মেয়ে শর্মিষ্ঠা রায় পরিবেশ বিজ্ঞানে সম্মান সহ সম্প্রতি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিয়েছে।
বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতে গভীর ব্যুৎপত্তি ও অনুরাগসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী দীপক রায়। তাই কাজের ফাঁকে নিজের সন্তুষ্টির জন্য লেখা-লেখি নিয়ে সময় পার করেন। ফেসবুকে জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে কবিতা লিখে থাকেন প্রতিদিনই, নিয়মিত। গান শোনা তাঁর অন্যতম প্রধান শখ। বিশেষতঃ রাগ প্রধান গান – এ উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ব্যপক আগ্রহ। যখনই অবসর পান গান শুনে সময় কাটানোই তার নিয়মিত অভ্যাস।