মায়ের সাজানো বাগান
– জয়শ্রী কর
ডালে ডালে মাণিক জ্বলে
দেখবি যদি আয় রে চলে
ছ’মাস আগে মায়ের হাতে লাগান এই গাছ,
রোজ বিকেলে মায়ের সাথে
জল দিতে যাই ঝারি হাতে
কখনো মা বলতো আমায় ঘাসগুলো তুই বাছ।
হরেকরকম ফলত ফসল
লংকা-বেগুন-ঢ্যাঁড়স-পটল
কাঠি পুঁতি শসার কাছে, বিকেলে ঠিকঠাক,
ছুটির দিনে ঝুড়ি ভরে
আনত তুলে সবজি ঘরে
গর্ত ভরে কড়াই দিতাম মা ঘোরাতে চাক।
বাবার গাছের আম্রপালি
কোনো বছর যায়নি খালি
সবার আগে উঠেই আমি কুড়িয়ে নিতাম আম,
ঘরের পাশে ফলের বাগান
উঠত পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণ
স্কুলে গিয়ে গাছের তলায় কুড়িয়ে খেতাম জাম।
টগর-বেলী-জুঁই-কাঞ্চন
বৃষ্টিতে পায় নতুন জীবন
প্রজাপতি ভ্রমর যুগল খুশিতে মশগুল,
দোয়েল-ফিঙে জুড়াত প্রাণ
প্রতিদিনই তুলত তুফান
চাঁপা ফুলের কুঁড়িগুলো যেন কানের দুল।
দাঁড়িয়ে আছে উঠোন পাশে
শিউলি-সুবাস আজও ভাসে
বাতাস এসে কানে কানে কী যে কথা কয়,
লাস্যময়ীর কানাকানি
ফোটে মুখে মধুর বাণী
গোলাপ-চাঁপা-মালতী-জুঁই সদা হাস্যময়।
হারিয়ে গেছে গল্পগুজব
– জয়শ্রী কর
পাড়ায় পাড়ায় গল্প-গুজব হয় না বিকেলবেলা
খোকা-খুকু মাঠে গিয়ে করে না আর খেলা।
নেই মনে সুখ, মাতামাতি
হারিয়ে গেছে বন্ধু সাথি
এ’ দুর্দিনে মুখে কুলুপ দিন কাটে একেলা।
পথপানে চেয়ে থাকি আসে না কেউ ঘরে
স্বজন সুজন সবাই যেন যাচ্ছে দূরে সরে।
দুর্বিষহ জীবনযাপন
বন্দি হয়ে ভাবছি এখন
পাশে গিয়ে বসব কখন মাকে আঁকড়ে ধরে।
পথ চলা খুব ভীতিপ্রদ লাগবে ছোঁয়া গায়ে
তাই দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছি পায়ে পায়ে।
ধরতে পারে ছোঁয়াচে রোগ
মানুষের তাই এত দুর্ভোগ
খাদ্যশস্য কিনছে সবাই গোল-দাগে দাঁড়ায়ে।
গঙ্গাসাগর মেলা
– জয়শ্রী কর
ঠিক করেছে দাদা একাই যাবে সাগরমেলা
ছোটো ছেলে বাধা দিতেই এল সকালবেলা।
যাবি রে বোন গঙ্গাসাগর
শুনেই হাসে আমার নাগর
বাড়ি এসে ডাকছে দাদা যায় না আর্জি ঠেলা।
এমন সুযোগ পাব না আর, বলছ যখন, যাব
তোমরা দুজন সঙ্গে গেলে আমিও বল পাব।
জলপথে দারুণ মজা
সাত ঘন্টায় দ্বীপে সোজা
ঝলমলে রোদ দুপুরবেলা লঞ্চে বসে খাব।
দুজন যাবি, শুনে আমার হৃদয় গেল ভরে
বাকি মাত্র কয়েকঘন্টা বেরিয়ে যাব ভোরে।
বউমণিকে সঙ্গে নেবে
ঠাকুরজামাই সামাল দেবে
ভালোবাসার বন্ধনে আজ কাটবে মজা করে।
ঠিক সময়ে রওনা হলাম লোকালে চারজনে
স্টেশন থেকে গেলাম ঘাটে পুলক জাগে মনে।
খেয়াল হল অনেক পরে
দাদার টিকিট দু’নম্বরে !
বলল দাদা, যাচ্ছি টা-টা, হল না একসনে।
বৌদিমণি ভাবছে বসে আমায় দিল ফাঁকি
পাশে ননদাই ননদিনী, রইবে ও’ একাকী।
চলছে দুটোই পাশাপাশি
ভর্তি জাহাজ চলছে হাসি
কেউ বা আবার হাতছানিতে করছে ডাকাডাকি।
দ্বিপ্রাহরিক আহার শুরু খুশির জোয়ার প্রাণে
খাবার পরে শিল্পী ক’জন মাতায় গানে গানে।
জাহাজ ঘিরে নজরদারি
কড়া নিয়ম হুকুম জারি
একই সূত্রে বাঁধা জীবন সাগরমেলার টানে।
জাহাজ এসে ভিড়ল ঘাটে সবাই গেল নেমে
বৌদিকে না দেখতে পেয়ে যাচ্ছে দাদা ঘেমে।
ভুগছিল যে হাঁটুর বাতে
আনল খুঁজে ছিল ছাতে
জলোচ্ছ্বাসের জলতরঙ্গ তখন গেছে থেমে।
ঘাটের থেকে আমরা সবাই চলেছি একসাথে
আপ্যায়নে নেইকো ত্রুটি, দায়িত্ব ঠিক হাতে।
পৌঁছে গেলাম সাগরমেলায়
ঘুরছি পথে রাতেরবেলায়
রাত বারোটায় হুড়োহুড়ি স্নানের লগন প্রাতে।
ভবঘুরের মতোই দাদা কাটায় অগোচরে
বৌদি আমি একটু পরে ফিরছি রাস্তা ধরে।
রাস্তা জুড়ে আলোর মেলা
চলতে গিয়ে পাচ্ছি ঠেলা
হন্তদন্ত হয়ে দাদা ফিরছে তখন ঘরে।
সাগরে স্নান হয়নি আমার তোমরা কোথায় ছিলে?
চলো আবার সাগরচরে ডুব দেব সলিলে।
‘স্নান না করে যাবি চলে
কেন এলি সদলবলে ?
সাগরবেলায় রাত কাটাবি বসে সবাই মিলে।’
চন্দ্রালোকে জলের নূপুর আসছে ভেসে কানে
লঞ্চে বসা মানুষগুলোর ছবি যে সবখানে।
দেখছি বসে ভোরের আকাশ
লাগছে গায়ে শীতল বাতাস
জনস্রোতে গা ভাসালাম ফিরতে না মন টানে।
প্রকৃতির হাতছানি
– জয়শ্রী কর
পাহাড় নদী ডাকে আমায়, ডাকে পাইন সারি
ঝলমলে ওই পাহাড়শ্রেণির দৃশ্য মনোহারী।
পাদদেশে গাছগাছালি রঙিন ফুলের মেলা
মেঘবালিকার সাথে রবির নিত্য চলে খেলা।
চূড়ায় চূড়ায় ছড়িয়ে আছে মুক্তাদানার হাসি
বরফ-রোদে মাখামাখি আনন্দ একরাশি।
আলোর স্পর্শে অপূর্ব রূপ ধীরগতিতে নদী
যেতে যেতে মনের কথা শোনায় নিরবধি।
নীল নয়না কুলুকুলু ডাকছে বারেবারে
মায়া-মাখা শুভ্র ফেণা আমার নজর কাড়ে।
পা চলে না দাঁড়িয়ে পড়ি দেখি দুচোখ ভরে
গুছিয়ে রাখি মানসপটে নিরালা প্রান্তরে।
রৌদ্রতাপে ঠিকরে পড়ে অপূর্ব এক দ্যুতি
কোথাও আমি পাই না খুঁজে একটুও বিচ্যুতি।
কবি পরিচিতি

জয়শ্রী কর। জন্ম জুন ২, ১৯৫৬তে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় কোলাঘাট থানার অন্তর্গত চিমুটিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে। মাতা কমলাবালা, পিতা রামপদ মাইতি।
কোদালিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রথম পাঠ। ১৯৭৪ এ ভোগপুর কেনারাম মেমোরিয়াল হাই স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে স্নাতক স্তরে কলা বিভাগে ভর্তি হন। পড়া চলাকালীন ১৯৭৬ এ ডক্টর অজিত কুমারের সঙ্গে শুভ পরিণয়। কৈশোর থেকেই খেলাধুলা, সেলাই ও শরীরচর্চার সঙ্গে তিনি যুক্ত। পরে গিটার, তবলা, যোগ ব্যায়াম এবং কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। নিজে একজন সংগীত শিল্পী ও সুরকারও বটে – বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি ও সংগীত পরিবেশন করে থাকেন।
প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘নীল আকাশের কোলে’ পাঠকমহলে খুবই সমাদৃত। রাজ্য সরকারের তরফে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরীর ফাউন্ডেশন এবং বঙ্গীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সভার যৌথ উদ্যোগে তার বই কেনা হয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গ্রন্থাগারগুলির জন্য। এছাড়া আরো দুটি কাব্যগ্রন্থ – ‘ভোরের বাঁশি’ এবং মায়াডোর’ – প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার কবিতা রচনার প্রেরণা। প্রতিদিন কবিতা লেখা, কাব্য আলোচনা আর গানবাজনা নিয়ে দিন কাটছে বর্তমানে।