বাসুদেব পাল – কবিতাগুচ্ছ

নদীর কন্ঠ

– বাসুদেব পাল

আমি নদী,
ভাটি দেশে বয়ে যাওয়া নদী;
পদ্মা, মেঘনা বা সুরমার মতো
কোন এক বহমান নদী।

পর্বত শিখর থেকে নিয়ে যাই বয়ে –
স্বচ্ছ সলিল ধারা তোমাদের মাঝে,
পাথর ভেঙ্গে ভেঙ্গে গড়ে তুলি মাটি,
পলিময় করে তুলি ফসলি জমি;
নেচে যাই গেয়ে যাই সর্পিল পথে।

একদিন সুদিন ছিল কত!
আমার রূপালী জলে
সোনালী বধুর নিত্য পরশে
অনাবিল শান্তিতে ছুঁইয়ে যেত মন।
আমার বুকের মাঝে সারি সারি নাও;
নায়ের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিদের গান,
মাঝিদের কন্ঠের গান,
আমার সুরের সাথে মিশে –
ভেসে যেত কোন এক স্বর্গের অচিন পুরীতে।

নদী, আমি নদী,
ভাটি দেশে বয়ে যাওয়া আমি এক নদী।
আজ আর সেই দিন নেই,
তোমাদের সভ্যযুগের সীমাহীন অত্যাচারে
আমার গতিপথে অবিরাম বাধা,
আমার শিরা উপশিরা গুলো বন্ধ করে
দখল করেছ তোমরা,
আমার দুই তীরে বাধ দিয়ে
স্রোতকে করেছ সংকীর্ণ;
আমার বুকে ছুড়ে দিচ্ছ
দুর্গন্ধময় আবর্জনা,
কারখানার বিষাক্ত বর্জ-
তাও নিক্ষেপ কর আমার বুকে,
আমার স্বচ্ছ জলধারা
তোমাদের বিষাক্ত ছোবলে
কলঙ্কিত, কালিমা লিপ্ত;
নিশ্বাস নিতে আজ বড় কষ্ট আমার,
আমার বুকে আজ ওঠে কান্নার ঢেউ-
কল কল কান্নার অবিরাম শব্দ।

কালের গর্ভ

– বাসুদেব পাল

কৃষকের সেই গোলাভরা ধান এখানে দেখি না আর,
গোয়ালের গরু নিয়েছে বিদায় গোয়ালই দেখা ভার।
জোংড়া মাথায় কৃষক ছোটে না লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে,
যায় না এখন ছৈ-অলা নায়ে মাঝি ভাটিয়ালী গেয়ে।
হয়েছে বিলীন কাদাভরা পথে গরুর হাম্বা ডাক,
যায় না শোনা সন্ধ্যায় ঝোপে বুনো শেয়ালের হাক।
এই বর্ষায় শিশুরা ভুলেছে কলার ভেলায় খেলা,
নদীর চরে কাদার মাঝে সড়াৎ সড়াৎ ঠেলা।
বৃষ্টির মাঝে গ্রামের মাঠে দামাল ছেলের দল,
ফুটবল হাতে ছোটে না এখন ভুলে গেছে সে সকল।
অগভীর জলে গামছা আঁচলে ছেঁকে ছেঁকে মাছ ধরা,
তাও আজ নেই – আছে শুধু ছবি বইয়ের পাতায় ভরা,
চৈত্রেতে নেই আড়ংএর মেলা, নবান্ন নেই অঘ্রাণে,
ঢেকিতে হয় না চাল গুড়া করা, পৌষের পিঠা পার্বনে।
হারিয়ে গেছে হুক্কা –কল্কে, মাটির গড়া বাসন,
হারিয়ে গেছে গরুর গাড়ি, পালকি নামের বাহন।
বায়োস্কোপ গেছে, টেলিগ্রাফ গেছে, বিদায়ের পথে রেডিও,
কালের গর্ভে বিলীন হবে জানিনা কত কী আরও।

শেষ সন্ধ্যা

– বাসুদেব পাল

দিনের শেষে আসছে দিন, কাটছে সময় বেশ,​
এই কুলেতে ভাবছি প্রভূ মধুর পরিবেশ।​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​এই তীরেতে অন্ধমোহে,​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ অন্ধমায়ায়, অন্ধ স্নেহে,​
অমৃত রূপে নিশি-দিন যাই গরল পিয়ে ,​
কাটেনা বাঁধন, ভাবব আমি তোমায় নিয়ে।

নৌকা আছে এই পারেতে আমার অপেক্ষাতে,​
দিনের শেষে যেতে হবে তোমারই সাক্ষাতে।​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ তবু কেন এই অবেলায়,​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​কাটে সময় অবহেলায়,​
ব্যার্থ প্রয়াস, বালির প্রাসাদ গড়ছি বারে বারে,​
ভুলেই গেছি যেতে হবে সন্ধ্যাতে ওই পারে।

ঐ পারেতে তোমার পাশে আমার আসল বাস,​
নাই যে কৃপার কঠোর কুঠার কাটবে মোহপাশ।​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​করছি যে জমা বালু নুড়িকনা,​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ বাড়ে তাতে বোঝা, বাড়ে যন্ত্রণা,​
করিনি যোগাড় পারের সচল পুণ্য হীরক-মনি,​
শেষ সন্ধ্যায় দিও প্রভূ তোমার চরণখানি।


কবি পরিচিতি

বাসুদেব কুমার পাল। জন্ম রামপাল উপজেলার বড়দিয়া গ্রামে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে, পিতা মণিদ্রনাথ পাল ও মাতা সরোজিনী পাল। বি, এসসি(অনার্স) ও প্রাণিবিজ্ঞানে এম,এসসি ডিগ্রী অর্জনের পর এখন আমড়াতলা চাঁপড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে এখন কর্মরত। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত – স্ত্রী লাবনী পাল এবং বাণী ও বর্ণ নামে দুই সন্তানের জনক।

ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। ছাত্রজীবনেই খুলনার বিভিন্ন দৈনিকে অনেক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে খুলনার দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে কবির কবিতা। এছাড়া তিনি উপন্যাসও লিখে থাকেন। – এ পর্যন্ত প্রকাশিত উপন্যাস একটি – স্বপ্নের মৃত্যু, অপ্রকাশিত উপন্যাস চারটি। তিনি আরো লিখেছেন ছোট গল্প ও ছোটদের জন্য ছড়া এবং রচনা করেছেন আধুনিক গান। শখের বসেই তার লেখালেখি, অবসর কাটে লিখে ও বই পড়ে। কবির লেখার ভিতর সম-সাময়িক বিষয় ও প্রকৃতিই প্রধান্য পায় বেশী।