আমায় নিয়ে শোক ও সুখ দ্বন্দ্ব
– যোষেফ হাজরা
শোক ও সুখের জীবনের তুমি এক গোলমেলে হাওয়া।
বয়ে যেও না, তাহলে প্রদীপ নিভে যাবে।
সেই অন্ধ প্রদীপের ইচ্ছে পূরণের দায় ভার
তুমি যদি নিতে নাই পার,
ক্ষুধার পরশ বুলিয়ে কখনও সহানুভূতি দেখিও না।
বড় কষ্ট হয়, নিজের দিকে ফিরে তাকাতে নয়,
আমার প্রতি তোমার করা সমস্ত আচরণ দেখে।
আমি তো আছিই কোন রকমে এই মহামারীর কোলে
সুখটা না হয় নিজের মত করে ভাঙেচুরে নিলাম।
তুমি আবার এই ভেবে আদিখ্যেতা কর না যে,
আমি খুব দুখী।
আমার কিন্তু এই হাড়হাভাতেই দিব্যি ঘুম হয়,
দিব্য আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন ইলিশের ঝোল খাব।
তোমার প্রতিটি কোষে কোষে যেটা জমে আছে,
সেটা নিরর্থক অপরিণামদর্শিতা।
ভয় হয় না তোমার?
যদি এই পাপের বোঝা নিয়ে কোনদিন দাঁড়াতেই না পার?
বরং তুমি আমার কাছে আস এই ভেবে
কতখানি কম হলে আমি আর কতদিন টিকব।
কতদিন পরে তুমি এই জমিতেই নোঙর রেখে
আস্ত একখানা সুরিখানা বানাবে।
আমি মহাকালের গ্রাসকে ছুঁয়ে বলছি,
আমিও খুব দ্রুত মাথা তুলে দাড়াতাম।
যেভাবে হাজার বছর ধরে গাছগুলি একহাত বড় হয়,
তুমি তো প্রকৃতপক্ষে একটি আগাছা,
দ্রুত তুমি বেড়ে উঠবে আর মারাও পড়বে।
সারারাত আমি জেগে থাকতে পারিনি
– যোষেফ হাজরা
সারারাত আমি জেগে থাকতে পারিনি, বিশ্বাস কর
ক্ষুধা, ঘুম, জ্বরা সমস্ত অবসন্ন করে ফেলেছিল আমাকে
আমি জেগে থাকতে পারিনি
এই যে নদীর বুক, যার গভীরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে
তোমার আর আমার কুচকানো চামড়ার দেহ
সেখানে আমি এখনও দেখতে পাই একটি ভাঙা কুড়েঘর
জীবনের পাতা থেকে ছলছল ছলছল করে মৃত্যু এপাড়ে,
স্মৃতিরা এত পূর্ণতা নিয়ে জেগে উঠতে পারে!
কই, তুমি তো আমাকে বলনি এর আগে
সেই বাদলের দিন এত পূর্ণতা নিয়ে ধরা দিল
সে কথা যদি আমি আরো আগে, বহু আগেই জানতাম
তবে আমি কবেই ভাসিয়ে দিতাম ঘরখানি
আর তুমি আমি বেহুলার মত ভেসে যেতাম পুণ্য স্নানে
এত ক্ষুধা, এত শোক, এত বিলাসিতার আবাস থেকে
উচ্ছ্বসিত সেই তাণ্ডবের সাথে মিশে যাওয়ার কী যে আনন্দ
আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থপর কীট যদি আগেই জানতাম
ইস্! যদি আগেই জানতাম
তবে কোনদিন কিচ্ছুটি চাইতাম না
শুধু বেঁচে থাকার জন্য কর্তব্যের বন্ধনে
অনন্ত পরপারের স্বাধীনতা খুঁজতাম
দেখই না, কী সহজেই আমরা জোৎস্নার আলো মাখি
ফুলের রেণু দিয়ে খেলি বিজয়ের হোলি
প্রজাপতির মত অধিকার করে রাখি সকল সুন্দর
কী দুঃখ! যেন বর্ষার ধারার মত সিক্ত পরশ দেয়
কী যন্ত্রণা! যেন ভোরের সূর্যের মত উষ্ণতা দেয়
কোথায় নেই দেখ রক্ত ও মাংসের
সেই তীব্র নিষাদের ছোবল
আমার চোখেও নেই কোন ঘুম, কোন জাগরণ
আর না আছে তথাকথিত কোন ক্ষুধা ও তৃষ্ণা
স্বর্গ সুখেই মরে যেতে পারতাম
– যোষেফ হাজরা
তুমি আর আমি স্বর্গ সুখেই মরে যেতে পারতাম
তোমার থরথর ঠোঁটের কোনে মিলিয়ে যেতে পারতাম
কিন্তু কোথায় কখন কী যে হয়ে গেল
আমি এতটুকু সামলে রাখতে পারিনি বৈশাখী ঝড়
তছনছ করে দিয়ে গেল তোমার আমার এই চাঁদ
এই আকাশ ভরা তারা
এই মন, সেই মন জোনাকি জ্বলা আলোর দিকে
ভুলেও তাকতে সাহস করে না
কারণ যদিওবা আমাদের সুখ সহ্য হল
ক্ষুধা আর দারিদ্র আছড়ে পড়ে জীর্ণ খড়ের চালে
এমনকি কোথায় কোন উন্নয়নের পথ চলা বড্ড কষ্ট
কেউ জানে না, জানতে চায় না, বুঝতে চায় না
কেনই বা আর চাইবে? হঠাৎ জীবন থমকে গিয়েছে সকলের
জীবিকা? এখন শুধু টিকে থাকাটাই সব
শুষ্ক খাঁচায় শুধু যেন আটকে থাকে প্রাণ ভোমরা
নইলে বসন্ত আর কখনোই বরণ করবে না আমাদের
আমার হারানো স্বর্গ, কবি মিল্টন তুমি বলে যাও
ফিরে কী আসবে? ধীরে ধীরে নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে
আমাদের কোলাহল। ভুতুড়ে নৈঃশব্দ্য নিচে ক্ষুধার পেষণ
শোক অথবা ক্ষুধা যেকোন একটিকে বরণ করে যেন নিতেই হবে
তুমি আর আমি সেই স্বর্গ সুখেই মরে যেতে পারতাম
যদিওবা এখন মরে যেতে হয় ক্ষুধা ও তৃষ্ণায়
তবুও তাকে ফিরে আসতেই হবে
আমার সাথে
তোমার কোন এক বসন্তে
হয়তো আমাদের নয়
হয়তোবা অন্যকারো
কবি পরিচিতি
যোষেফ হাজরা। ছদ্ম নাম তারুণ্যের কবি।
আমি আমার জীবন গঠনের সময় বহু জায়গার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম। শহরের হাওয়া বা মফসলের জীবন এমনকি উত্তর আর দক্ষিণাঞ্চলের জীবনধারার ছোঁয়া আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি। আমার জন্মস্থান মোংলার স্বনামধন্য সেন্ট পলস হাসপাতালে। ১লা মে জন্ম হাওয়ায় ফাদার মারিনো রিগন আমার নাম যোষেফ (আধুনিকায়নে যোসেফ) রাখে। পিতা তাপস হাজরা, মাতা এন্ড্রো রিনা নাথ।
আমি প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমাদের ছোট নদী” কবিতা পড়ে তার সম্পর্কে জানি তখন থেকেই তিনি আমার অনুপ্রেরণা। এ জন্য চিত্রকলা, সংগীত, আবৃত্তি, অভিনয় ও পরবর্তীতে সেন্ট পলস স্কুলের লাইব্রেরি ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অপার সুযোগে লেখালেখির হাতে খড়ি দেই। সকল শিল্প-সংস্কৃতি থেকে আমি লেখালেখি করতে বেশি ভালবাসি। কারণ মনের কথা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করে, ভাষার জাদুকারিত্বে, জ্ঞান ও দর্শনের যে সমন্বয় হয়, সেই আত্মদর্শনে সম্পূর্ণ আত্মতৃপ্ত করতে সক্ষম। আমি যদিও রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব মানি তবুও তার ধাঁচে আমি লিখি না। আমি কাব্য ও রচনায় অন্যান্য ঢং রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করি যাতে কেউ পড়ামাত্রই বুঝতে পারে এই লেখনীর স্রষ্টা কেবলমাত্র আমি।