হরিপদ মন্ডল – মৃত্যুশোক

হরিপদ মন্ডল – জুলাই ২০, ১৯?? – আগস্ট ১৫, ২০২০
কাইনমারি, মোংলা, বাগেরহাট, বাংলাদেশ

আগস্ট ১৫, ২০২০ সাল রাত ১২টা ৫৪ মিনিটে মোংলার কাইনমারীর নিজ বাসভবনে আত্মীয়-স্বজন ও গুণমুগ্ধদের কাঁদিয়ে বাবু হরিপদ মন্ডল স্বর্গবাসী হয়েছেন। জীবনের শেষ দিনগুলিতে দীর্ঘদিন তিনি অসুখে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ৬৮/৬৯ বছর বা এর কাছাকাছি হবে। (এস এস সি পাশের বছর ১৯৬৭ সাল – সেই হিসাবে অনুমান করা হয়েছে। )

তিনি ছিলেন এই অঞ্চলের কৃতি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে বিশেষ একজন, এই এলাকারই অন্যতম ও সুপরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর সহকারী প্রধান শিক্ষিক। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন ও আদর্শ একজন শিক্ষক। তাঁর মৃত্যুর খবরে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা গভীর সববেদনা জ্ঞাপন করেছে এবং তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে নানাজনে ফেসবুকে অনেক মন্তব্য রেখেছে। শিক্ষিক হিসাবে বাবু হরিপদ মন্ডল স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য দৈনিক ভাটিরদেশ-এর পক্ষ থেকে এই সব মন্তব্যের কিছু কিছু নিচেয় তুলে দেয়া হলো। এই সব মন্তব্যে তাদের প্রিয় শিক্ষকের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা সহজে উপলব্ধ।

  • তাঁর অমর আত্মার জন্য প্রার্থনা। তিনি ছিলেন আমার প্রিয় শিক্ষক – মল্লিকা রানি হালদার।
  • আমার একজন প্রিয় শিক্ষক কে হারালাম – মারিনা সরদার।
  • একজন প্রিয় শিক্ষক কে হারালাম – মোহন মজুমদার।
  • আমার স্কুল জীবনের একজন অনুসরণীয় আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব হরিপদ স্যার – জুবায়ের জিকো।
  • স্যারকে দেখতে যাব যাব করে করোনার জন্য দেরি হচ্ছিল। দেখাটা আর হলোনা! – জান্নাতুন্নেসা যুথী।
  • একজন সত্যিকারের শিক্ষাগুরুকে হারালাম….ওপারে ভালো থাকবেন স্যার…বিনম্র শ্রদ্ধা – তুহিন সরকার।
  • হরিপদ স্যারের সাথে আমার মধুর স্মৃতি রয়েছে যখন ১৯৭৯-৮০ সালে খুলনা টিটি কলেজে বি এড কোর্সের জন্য পড়াশুনা করছিলাম। আমরা হোস্টেলে একই রুমে ছিলাম – মাইকেল বিশ্বাস।
  • বড় ভালো মানুষ ছিলেন – সরদার বুলবুল আজিজ।
  • আমাকে অনেক স্নেহ করতেন উনি। কর্ম জীবনে ওনার যে স্নেহ আর ভালোবাসা পেয়েছি তা ভোলার নয়। ব্যথা জানানোর ভাষা নেই – শুক্লা বোস।
  • স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। স্যার এর অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। আমি স্কুল জীবনে স্যারের প্রচুর স্নেহ পেয়েছি। কিছু দিন আগেও স্যার বিছানায় শয্যাশায়ী হওয়ার পূর্বে ও (১ বছর পূর্বে হতে পারে) স্যার এর সাথে দেখা হলেই স্নেহের সাথে জড়িয়ে ধরতেন এবং অনেক স্মৃতিচারণ করতেন। স্যারের স্মৃতি শক্তি ছিল খুব ভালো – মাহবুব রহমান।
  • স্কুল ছাড়ার প্রায় ৩৫ বছর পরে কয়েক বছর আগে স্যারের সাথে দেখা হল। বার্ধক্য স্পষ্ট কিন্তু স্যার আমাকে চিনতে ভুল করেননি। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কথা বলছিলেন আর অতীত স্মৃতিচারন করছিলেন – রফিকুল ইসলাম মারুফ
  • মোংলাবাসীরা একজন স্বনামধন্য এবং নিবেদিত শিক্ষককে হারালো, আমরা আমাদের সম্মানিত ও প্রিয় শিক্ষকে হারালাম – শেখ মোতাসিম বিল্লাহ।
  • দুঃখিত, আমরা একজন আদর্শ শিক্ষক কে হারালাম – স্টেফেন বিশ্বাস।
  • একজন আদর্শ শিক্ষক ও ভালো মানুষের আকস্মিক তিরোধানে খুবই মর্মাহত – আলী আহমেদ।
  • আমার কাছে তিনি অত্যন্ত সম্মনাজনক ব্যক্তি। আমরা পরস্পরের খুব কাছাকাছি থাকি – উত্তম বিশ্বাস।
  • গভীরভাবে মর্মাহত, একজন ভালো মানুষ হিসাবে তিনি নিজস্ব জ্ঞানে সমৃদ্ধ – দয়াময় মন্ডল।
  • আমি একবার বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে সেন্ট পলস্ স্কুল কেন্দ্রে কৃষি বিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষার বহিরাগত শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্যারের সাথে পরিচয় হয়। সেদিন বুঝেছিলাম, শিক্ষক হিসাবে যেমন তুলনাহীন এবং মানুষ হিসাবে অমায়িক ও মহানুভব – অর্ধেন্দু শেখর মজুমদার।
  • স্যার, আর দেখা হলোনা। কে কাঁধে হাত রেখে বলবে “ভালো আছিস বাবা?” – জাফরীন বিল্লাহ।
  • আমার অনেক প্রিয় একজন শিক্ষক উনি। আমার অনেক মজার স্মৃতি আছে স্যারকে নিয়ে – ফারি সিদ্দিকী।
  • আমার প্রিয় স্যারদের ভিতর অন্যতম – দেলোয়ার হুসেইন।
  • খুবই দুঃসংবাদ। তিনি আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন এবং আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। তাঁর অভাব খুব অনুভব করি – ক্যারোলিনা রোজারিও।
  • ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন স্যারের আত্মাকে চিরশান্তিতে রাখেন। অনেক স্মৃতি, স্নেহ, ভালোবাসা আমার জীবনের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে, স্যার কে নিয়ে। আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, তখন প্রধান শিক্ষক সুদান স্যারের কথা মত স্যারের সাথে দেখা করলাম। স্যার আমাকে তপেশ দের বাড়িতে পাঠালেন, তপেশের বাবা নিরঞ্জন কাকুর সংগে দেখা করতে, যেন ওখানে থেকে আমি পড়াশোনা করতে পারি। সে বছর থেকে সমস্ত স্কুল জীবন আমার ওখানেই কেটেছে। আমি হয়ে গিয়েছি নিরঞ্জন কাকুদেরই বাড়ির ছেলে। অসীম কৃতজ্ঞতা চিত্তে আজ কায়মনো বাক্যে স্যারের জন্য প্রার্থনা করি – শরদেন্দু শেখর রায়।
  • তিনি একজন ভালো এবং নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন যিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসতেন – বিজয় দ্য’ক্রুজ।
  • স্যার একজন ভালো মানুষ ছিলেন – মাফতুন আহমেদ মুকুল।
  • ভালো মানুষ ছিলেন স্যার – লাভলী গাইন।
  • আমরা একজন গুণীজনকে হারিয়েছি – এইচ এম জাহিদ।
  • আরও একটা আলো নিভে গেল , হাজার হাজার মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন উনি – সঞ্জয় মন্ডল।
  • স্যারের ফিজিক্স ক্লাস ছিল মনোমুগ্ধকর – সুলতানা সুমি।
  • স্যার, আপনার হাতেই আমার পদার্থ বিজ্ঞান হাতে খড়ি। আপনার জন্যই পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স শেষ করার সাহস হয়েছিল – বিচিত্র বিশ্বাস।
  • শ্রদ্বেয় শিক্ষক হরিপদ স্যারের মৃত্যু সংবাদ আমাকে কষ্ট দিয়েছে এবং ভারাক্রান্ত করেছে। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮০ সাল অবধি সেন্ট পলস এর ছাত্র থাকা অবস্থায় উনার সান্নিধ্যে আসবার সুযোগ হয়েছে। একজন অত্যন্ত জ্ঞানী বিজ্ঞানের শিক্ষক যিনি বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো অত্যন্ত সহজে বুঝাতে পারতেন। প্রয়াত স্যারের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি – আশুতোষ বড়ুয়া।

সেন্ট পলস হাই স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত স্কুল ম্যাগাজিন “শুকতারা”য় তাঁর নিজের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি – শিশু থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পড়াশুনা পাঠশালায়, কাইনমারী ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে তৃতীয় শ্রেণির পাঠ শেষ করে ফেব্রুয়ারি ১৩, ১৯৫৮সালে নিয়ম মাফিক টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে সেন্ট পলস হাই স্কুলেই তিনি ভর্তি হন চতুর্থ শ্রেনিতে। তখন কে জানতো একদিন এই স্কুলের শিক্ষক হিসাবে তাঁর কর্মজীবনের গৌরবময় দিনগুলি অসংখ্য শিক্ষার্থীদের প্রাণে জ্ঞানের শিখা প্রজ্জ্বলিত করবে? তাঁর ছাত্রেরা যেমন তাকে স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সাথে, তিনিও তেমনি তাঁর নিজের শিক্ষদের মনে রেখেছিলেন প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের প্রতীক হিসাবে। নিজের শিক্ষকতা জীবনে তিনি শুধু তাদের আদর্শই অনুসরণ করেন নি, তিনি যে তাদের চিরকালের ছাত্র সেই কথা স্মরণ রেখেছেন চিরকাল। তাঁর লেখা থেকেই – “১৯৯২ সালে রেভাঃ ফাঃ মারিনো রিগন এস এক্স মহোদয়ের নির্মিত শেলাবুনিয়ার গির্জাঘর উদ্ধোধনীর সময় পুনরায় রেভাঃ ফাঃ রবার্ট ম্যালনী, এস এক্স আসলেন। শিক্ষকতায় তখন সহকারী শিক্ষক থেকে সিনিয়র শিক্ষকের পদমর্যাদা পেয়েছি। বাবু ফ্রান্সিস সুদান হালদার যুগ্ম প্রধান শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষিক হয়েছেন। কিন্তু আমরা দুজন শ্রদ্ধেয় ফাঃ রবার্ট এস ম্যালোনী-এর কাছে ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রই রয়ে গেলাম। যে কটা দিন ছিলেন সর্বদা তাঁর সঙ্গেই কাটিয়েছি। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা বর্তমানে যারা শিক্ষক বা শিক্ষিকা সবাই তাঁর কাছে শিক্ষক বা শিক্ষিকা। কিন্তু আমরা দুইজনই ৪র্থ শ্রেনির ছাত্র রয়ে গিয়েছি।”

বলা বাহুল্য, তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের এক বিরাট অংশ আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত – প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি ও বেসরকারি উচ্চ পদে কর্মরত, ডাক্তার, নার্স, ফাদার, সিস্টার, সাংবাদিক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, বিডিআর, ম্যাজিস্ট্রেট, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদে – দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন এলাকা ও অঞ্চল তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের অবদান সমৃদ্ধ। নিজের শিক্ষকদের এতটা শ্রদ্ধা করতেন বলেই তিনিও পেরেছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক হতে – তার নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শ্রদ্ধার ও প্রিয় হয়ে উঠতে।

তাঁর মৃত্যুতে আমরাও গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং তাঁর আত্মার জন্য শুভ প্রার্থনা রাখছি। আমাদের প্রত্যাশা – মোংলা এলাকার জ্ঞানের প্রসারে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকুক।