আজ ১৫ই আগষ্ট, বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদত বার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে।
বঙ্গবন্ধু কি বুঝতে পেরেছিলেন অশুভ কিছু ঘটতে যাচ্ছে? তেমনই মনে হয় বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন একান্ত সচিব ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকার থেকে। প্রতিদিন দিনের কর্মব্যস্ততা সমাপ্ত হলে সন্ধ্যায় গণভবন থেকে যথা নিয়মে ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের এই সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, প্রতিদিন কাজ শেষে গণভবনের সামনের লনে একাকী পায়চারি করতেন বঙ্গবন্ধু – গাছেদের সঙ্গে কথা বলা, লেকের পানিতে মাছেদের সঙ্গে খেলা করা সবই ছিল তাঁর নিয়মিত অভ্যাস। তবে তাঁর মৃত্যুর একদিন আগে, ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগষ্টের সন্ধ্যায় গণভবনের বাইরে দলবল নিয়ে মুক্ত আলোচনার সেই নিত্যকার আসর বসেনি। সেদিন দুপুরে নোয়াখালীতে ভারতীয় একটি হেলিকপ্টার ভূপতিত হয় – সেই ঘটনায় অন্যান্যরা ব্যস্ত ছিলেন।
এরই মধ্যে একটি ঘটনা ঘটে – সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য সেদিন এসেছিলো একটি কালো গাড়ি। জীবনের এই সন্ধ্যা যে তাঁর জীবনের শেষ সন্ধ্যা মনের অস্পষ্টতায় তাই বুঝি ধরা দিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর কাছে – কালো গাড়ি দেখে অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, “বঙ্গবন্ধু গাড়ি দেখে বারবার একটি মন্তব্য করেন, ‘আজকে কালো গাড়ি’! আমার শোনা ওটাই তার শেষ মন্তব্য। আমরা তাকালাম। খুবই বিষন্ন মন নিয়ে বিদায় নিলেন বাঙালি জাতির পরম সুহৃদ শেখ মুজিবুর রহমান!” এটা সত্যিই একটা আশ্চর্য্যের বিষয়! হয়ত একটা অদৃশ্য ইংগিত ছিল এই ঘটনায় এবং বঙ্গবন্ধু তা বুঝতে পেরেছিলেন একটা কিছু ঘটনা ঘটবার আশংকায়। রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার স্বার্থে প্রটোকলের লোকরাই ঠিক করতো বঙ্গবন্ধু কোন দিন কোন গাড়িতে চড়বেন। তিনটি গাড়িতে যাতায়াত করতেন তিনি। তার মধ্যে একটি সাদা ও একটি কালো রঙের। এর আগেও উনি কালো গাড়িতে চলেছেন – কিন্তু এই ক্ষণের মত বিমর্ষতা তো আর কখনো দেখা দেয় নি বঙ্গবন্ধুর মনে! খুবই বিষন্ন মন নিয়ে বিদায় সে দিনের গনভবন থেকে নিলেন বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান!’ তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন – সময় ফুরিয়ে আসছে?
এর পরের ঘটনা সবার জানা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সেনাবাহিনীর বিপথগামী কয়েকজন সদস্যরা। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
অস্ত্র দিয়ে কাউকে হত্যা করা যায়। কিন্তু তার কীর্তি ও অবদানকে মুছে ফেলা যায় না। আজকের বাংলাদেশ সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অবদানকে বাংলদেশের ইতিহাস হতে মুছে ফেলার অনেক প্রচেষ্টা চলেছে তাঁকে হত্যা করার পর। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে যার এত বড় অবদান, যার কীর্তি এত গৌরবময়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকা এত উজ্জ্বল, তাঁকে কি এত সহজে উপড়ে ফেলা যায়?
২০০৪ সালে বিবিসি আয়োজিত একটি জরিপে শ্রোতাদের মনোনয়নে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই বজ্রকন্ঠ বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার পথ নির্দেশনা দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেস কোর্স ময়দানের এক জনসভায় তাঁর বজ্রঘোষণা “…মনে রাখবা- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা” শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নয়, বিশ্বের নিঃপীড়িত, অবহেলিত ও শোষিত সমস্ত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের ঘোষণা। এ ডাক শুধু বাংলাদেশের আনাচে-কানাচেই নয়, বিশ্বের সর্বত্র ঢেউ তুলেছিলো বিপুল উৎসাহে। মুক্তির সংগ্রামে কত প্রাণ হলো বলিদান, লক্ষকোটিবার ধ্বনিত হলো ‘জয় বাংলা’ বাংলার গান। বাঙালির আশা, বাঙালির ভাষা আকাশ ছোয়া যে ঝড় তুলেছিলো সেই ঝড়ে উড়ে গিয়েছিলো অশুভ শক্তির সব চক্রবাণ।
বঙ্গবন্ধুর কি মৃত্যু আছে? চিরকাল তিনি সকল বাঙালির হৃদয়ে মহান, প্রেরণায় অনুপ্রাণন…
-অনুপ মজুমদার