এক ছন্নছাড়া জীবন হইতে
– দীপক রায়
১
১৯৭৮ সালের কথা। সরকারী বি. এল. কলেজের একাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞানের ছাত্র আমি। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় পত্রের ঠিকানা ধরিয়া নাছোড়বান্দা এক ভবঘুরে কিশোরবন্ধু না বলিয়া না কহিয়া আমার লজিং বাড়ীতে আসিয়া উদয় হইলো। আমার থাকিবার গৃহের গৃহস্বামী তাহাকে দেখিয়া আনন্দিত হইলেন। এ গৃহখানিতে আমার থাকিবার ব্যবস্থাই শুধু ছিলো, দুই বেলা আহারের ব্যবস্থা ছিলো তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতার গৃহে। রাত্রে পাঠ্যকার্যক্রম সমাপ্ত হইলে রাত্রির খাবারের জন্য ডাক আসিলো। আমি বন্ধুটিকে সাথে লইয়া লজ্জাবনত মস্তকে খাবারের জায়গা বারান্দায় গিয়া উপনীত হইলাম। দেখিলাম দুইটি আসনই পাতা রহিয়াছে। মনে খানিকটা ভরসা পাইয়া বসিয়া পড়িলাম। ঝাঁঝালো কন্ঠের অধিকারিনী বৌদি কোনরূপ বাক্যব্যয় না করিয়া খাবার পরিবেশন করিলেন। কোনো রূপ ভালোমন্দ কোনো কথাই বলিলেন না। ঝড়ের কিছুটা আভাস পাইলাম। খাওয়া শেষ করিয়া উঠিয়া পড়িলাম।
বন্ধুটিকে কিছুই জানিতে বা বুঝিতে দিলাম না। সত্যি কথাটা হইলো, হঠাৎ করিয়া আসিয়া পড়ায় তাহার উপর মনে মনে ভারি রুষ্ট হইয়াছিলাম। যাহাই হউক, সকাল হইলে উহাকে লইয়া কলেজে রওনা হইবো, এই কথা ভাবিতে ভাবিতে দুইজনে একই বিছানায় শুইয়া পড়িয়াম। শুইয়া নিম্ন স্বরে কিছু গল্পটল্প করিয়া এক সময় ঘুমাইয়া পড়িলাম।
২
সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া প্রাতঃক্রিয়াদি সম্পন্ন করিয়া কলেজে যাইবার কাপড় পরিয়া লইলাম। খাবারের জন্য বন্ধুকে লইয়া ওই ঘরের বারান্দায় উঠিয়া আসন পাতিয়া দুই জনে বসিয়া পড়িলাম। ভদ্রমহিলা কোনো রূপ ভূমিকায় না যাইয়া সরাসরি আমার অতিথি বন্ধুকে খাবার সরবরাহ করিতে অস্বীকৃতি জানাইয়া বসিলেন। তাহার ধরনটাই ছিলো ওই প্রকৃতির। আমি কিয়ৎকাল বসিয়া থাকিয়া তড়াক করিয়া উঠিয়া পড়িলাম। আমার জন্য থালায় গুছিয়ে রাখা ভাত ওইখানেই পড়িয়া রহিলো । ঘরের দরজায় তাহাদের কিশোরী মেয়েটি কেমন হায় হায় মুখোভাব করিয়া আমাদের নিষ্ক্রান্ত হওয়া পথের দিকে তাকাইয়া রহিলো। মায়ের প্রতি তাহার অসন্তুষ্টির ব্যাপারটি প্রকটভাবে তাহার মুখে প্রকাশিত হইলো। মেয়েটির কথা আজ মনে পড়িতেছে। সে সপ্তাহান্তে আমার ময়লা কাপড়-চোপড় লইবার জন্য আমার কক্ষের সামনে আসিয়া মাথা নীচু করিয়া দাঁড়াইতো; কখনও বা “ভাত অইছে” বলিয়া খুলনার সহজ-সরল ভাষায় আমাকে ডাকিয়া যাইতো। একটি নিদারুণ দুঃখের খবর হইলো, মেয়েটি আজ আর ইহজগতে নাই। শুনিয়াছি তাহার বিবাহ হইয়াছিলো আড়ংঘাটা নামক এক গ্রামে। সেখানে জলবদ্ধতার কারণে সর্পদংশণে তাহার অকাল মৃত্যু হইয়াছিলো। তাহার পিতামাতারও মৃত্যু হইয়াছে অনেক কাল পূর্বে। যদিও তাহাদের মৃত্যুর স্বাভাবিক বয়স তখনও হয় নি।
যাহা হউক, ওইদিন ‘অপয়া’ ভবঘুরে বন্ধুকে লইয়া খালিপেটে লজিং গৃহ হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম কলেজের উদ্দেশ্যে। পথে বন্ধুটি আমাকে থাকিবার একটি নতুন জায়গা খুঁজিয়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়া বসিলো। তাই সেইদিন কলেজের দিবসের প্রথমভাগের ক্লাসগুলো কামাই করিয়া তাহার সহিত দৌলতপুর থেকে ২৫ পয়সা বাস ভাড়ার ( বি এল কলেজের ছাত্র হিসাবে) দূরত্বে খুলনা-যশোহর হাই ওয়েতে একটা জায়গায় আসিয়া নামিলাম। বন্ধুটি সামাজিক যোগাযোগে অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী ছিলো। হয়তো এই কারণেই তাহাকে আমি বেশ খানিকটা পছন্দ করিতাম। সে রাস্তার পাশের একটা গলিতে অদৃশ্য হইয়া গেলো। আমি তাহার সহিত যাইতে অস্বীকৃতি জানাইয়া রাস্তার পাশে একটি দোকানের সামনে অপরিসীম ধৈর্য্য প্রদর্শনপূর্বক ঠায় দাঁড়াইয়া রহিলাম। বিব্রত বোধ করিবার কোনো কারণ উপলব্ধি করিলাম না, কারণ হাতে ছিলো সরকারী বি এল কলেজ মূদ্রিত নোট বই আর ‘অ্যালজেব্রা, ক্যালকুলাস’ ইত্যাদি লেখা কঠিন বিষয়ের দুই একটি পাতলা বই। তখনকার দিনে বি এল কলেজের ছাত্র হওয়ার ব্যাপারটি ছিলো একটি সম্মানের আর তার সাথে ঈর্ষণীয় ব্যাপারও!
প্রায় ঘন্টাকাল পর বন্ধুটি পান চিবাইতে চিবাইতে তাহার দুইপাশের কম করিয়া দেড় ফুট দেড় ফুট করিয়া মোট ৪ ফুট (শরীর সহ) জায়গা লইয়া তাহার নিজস্ব ভঙ্গীতে হেলিয়া দুলিয়া হাসিমুখে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলো। আমি কপট রাগ দেখাইয়া প্রথমেই তাহাকে এতো দেরি করিবার হেতু জানিতে চাহিলাম। তাহার শারিরীক ভাষা কেনো জানি আমাকে একটি আগাম সুখবর সরবরাহ করিতেছিলো। হঠাৎ কলেজমুখী একটি বাস আসিয়া পড়ায় বিলম্ব না করিয়া দুইজনে তাহাতে উঠিয়া পড়িলাম।
৩
এক সকাল বেলায় বেশ খানিকটা আশা লইয়া একাই আসিয়া উপস্থিত হইলাম পথের বাজারে সম্ভাব্য নতুন লজিং বাড়ীতে। বন্ধুর সহিত এ বাড়ীর গৃহকর্তার পূর্বালোচনার সূত্র ধরিয়া কর্তার অনুপস্থিতিতে গৃহকর্ত্রীর সহিত কিছু ইতিবাচক কথাবার্তা হইলো। তবে তিনি সর্বশেষ কথাটি বলিতে পারিলেন না। খানিকটা আশাহত হইয়া কিছুটা নিরানন্দে নিমজ্জিত হইলাম। পরিবারটির খুলনা শহরের বড় বাজারে বৃহত আকারে চাউলের ব্যবসা। কর্তার ইচ্ছা অনুযায়ী ওই দিন মধ্যাহ্নেই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য আমাকে শহরে তাঁহার ব্যবসাস্থলে যাইতে হইলো।
শুনিয়াছিলাম তিনি রাশভারি মেজাজি মানুষ। ছয় সন্তানের ব্যবসায়ী পিতা। সন্তানরা তাঁহার ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকিতো। প্রথম সাক্ষাতটি যেমন হইবার কথা ভাবিয়াছিলাম, তেমন কিছুই ঘটিলো না। বি এল কলেজের কথা জানিয়া তিনি বেশ প্রসন্ন হইলেন বলিয়া মনে হইলো। তাছাড়া এই কিশোর বয়েসটিতে কেমন যেন কম ভয় ভীতি কাজ করিত মনের ভিতরে। বলিলেন স্কুল পড়ুয় তাঁহার তিন পুত্রকে পড়াশুনায় সাহায্য করিতে হইবে। খাওয়া ও থাকিবার ব্যবস্থা তিনি করিবেন। জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম পুত্র দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। যথাক্রমে মানবিক ও বানিজ্য বিভাগে অধ্যয়ণরত। বয়সের বিবেচনায় মনে হইলো বড়টি আমার সমবয়সী। হয়তো বা দুই এক বছরের ছোটো। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া কনিষ্ঠ পুত্রটি বেশ বেপরোয়া তা তিনি প্রকাশ করিয়া দিলেন। পড়াশুনা সংক্রান্ত আমার পক্ষ হইতে কতিপয় প্রশ্নে তিনি বেশ প্রীত হইয়া সহজেই তাঁহার বাটীতে আমাকে থাকিতে দিতে রাজী হইলেন। সে কথা সরাসরি না বলিয়া তিনি তাঁহার জন্য বাড়ী হইতে পাঠানো দুপুরের খাবরের খালি ক্যরিয়ারটি আমার দিকে বাড়াইয়া ধরিয়া এক ট্রাক ড্রাইভারের সহিত আমাকে তাঁহার বাড়ীতে যাইতে বলিলেন। যেন ‘চাকরিটি’ হইয়া গিয়াছে এমন মনে করিয় আমি কিছুটা ভয়ে অদূরে দন্ডায়মান ট্রাকের চালকের পাশে উঠিয়া বসিলাম। এমন পরিস্থিতি এবং ট্রাকভ্রমণ ছিলো আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। ট্রাকচালক খানিকটা ভাব লইয়া চালাইতে লাগিলো। অল্প সময়ের মধ্যে সে আমাকে আমার গন্তব্যে নামাইয়া বিকট শব্দ তুলিয়া ধূলা উড়াইয়া নিষ্ক্রান্ত হইলো।
বাড়ীটি বড় রাস্তার কাছেই। আমাকে এতো তাড়াতাড়ি এবং ‘টিফিন ক্যারিয়ার’ হাতে ফিরিতে দেখিয়া গৃহকর্ত্রী মাসিমার মুখে প্রথমবার হঠাৎ করিয়া খানিকটা নির্মল হাসি লক্ষ্য করিলাম। এর কারণ হয়তো বা আমি সত্যিই বাবুর সহিত দেখা করিয়া আসিয়াছি, খাদ্য বহনকারী বস্তুটি তাহার অকাট্য প্রমাণ; আর একই সংগে কর্তাবাবু তাঁহার সদয় সম্মতি দিয়াছেন আমার থাকিবার ব্যাপারে। স্বামীর বিভিন্ন কাজ-কর্মের প্রকৃয়া-পদ্ধতি স্ত্রী ব্যতীত আর ভালো কেইবা বুঝিতে পারে।
মাসিমার আমন্ত্রণে সেদিন দুপুরে ওবাড়ীতেই আমাকে আহার গ্রহণ করিতে হইলো। কোনো ভাবেই না বলিবার সুযোগ বা ইচ্ছা কোনোটাই কি আমার ছিলো? ভাতটা ছিলো লম্বা দামী চাউলের! কারণটা না বুঝিবার কিছুই নাই। কারণ সৌখীন ব্যবসায়ী পরিবার বাড়ীতে সেই উৎকৃষ্ট বস্তুটিই ভোগ্য বলিয়া বিবেচনা করেন যাহা লইয়া তাঁহাদের কারবার। মনে কেনো জানি এক রকম ফুরেফুরে আনন্দ লইয়া যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তলপিতলপা লইয়া ফিরিয়া আসিবার প্রতিশ্রুতি দিয়া চলিয়া আসিলাম। তবে আমার ছাত্রদিগের সহিত সেদিন আমার দেখা হইলো না।
৪
প্রথম লজিং বাড়ীর কাছেই আমার তিনজন ছাত্র ছিলো। তাহারা রাতের বেলা আমার কাছে অংক আর ইংরেজী গ্রামার শিখিতো। উহাদিগের একজন আমার ট্রাঙ্কটি মাথায় বহন করিয়া বর্তমান কুয়েটের (তখনকার খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) গেইট থেকে একটা সাইকেল ভ্যানে তুলিয়া দিলো। ছেলেটির নাম ছিলো পঞ্চানন ( সবাই পঁচা বলিয়া ডাকিতো)। হয়তো বয়সে আমার চেয়ে খানিকটা বড়ই ছিলো। কারণ বার দুই এস এস সি পাশ করিতে না পারিয়া তৃতীয় বারের জন্য সে প্রস্তুতি লইতেছিলো। তাহাকে মনে রাখিবার একটা কারণ ছিলো, সে আমাকে যাহার পর নেই ভালো বাসিতো আর সম্মান করিতো। তাহাকে আমি তাহার অনুরোধে তুমি সম্বোধন করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম, আর সে আমাকে বরাবরই আপনি বলিতো। আর একটা ব্যপার ছিলো: পাটীগণিতের বর্তমান মূল্য কথাটাকে সে বট্টমান মূল্য বলিয়াই চালাইয়া দিতো। কোনো ভাবেই ঠিক করিতে না পারিয়া আমি হাল ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। অপর দুই ছাত্র (সহোদর) ইহা লইয়া মুখ টিপিয়া হাসিতো।
নিজের নাম ও কলেজের নাম লেখা ট্রাঙ্ক( তখনকার দিনে বাক্সপেট্রা যাহাতে হারাইয়া না যায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মতো ছাত্ররাও এমন করিয়া লিখিয়া লইতো) লইয়া ভ্যানসহ নতুন লজিং বাড়ীর গেইট দিয়া ভিতরে বারান্দার সিঁড়ির কাছে আসিয়া দাঁড়াইলাম। আওয়াজ পাইয়া আমার ছাত্রত্রয়ের কনিষ্ঠটি স্মিত হাসি মাখা মুখে জ্যেষ্ঠটির সহায়তায় ভ্যান হইতে আমার বেশভারী ট্রাঙ্কটি নামাইয়া লইলো। দেখিলাম উভয়ই বেশ লম্বা আর সুদর্শনও। মধ্যম ভ্রাতাটি কিঞ্চিৎ সাবধানী, স্বল্পভাষী আর লাজুকও বটে। না ভাবিয়া হঠাৎ করিয়া কোনো কিছু করিবার বিন্দুমাত্র লক্ষণও তাহার মধ্যে দেখিতে পাইলাম না। ভ্যানওয়ালাকে বিদায় করিয়া বারান্দায় উঠিয়া দাঁড়াইলাম।
একতলার পুরানো দালান। সমুখে (উত্তরমুখী) প্রসস্থ বারান্দার দুই প্রান্তে দুইটি কক্ষ। ভিতরে বেশ বড়সড় দুইটা শোবার ঘর। পূর্ব প্রান্তে সংলগ্ন বারান্দায় ছেলেদের থাকিবার লম্বা ঘরে দুইটি খাট পাতা। উহার একটি আমার জন্য বরাদ্দ হইলো। বাড়ীর পিছনে ঘাট বাঁধানো পুকুর। সন্ধ্যা হইলে ঘাটে বসিবার স্থানের মাথার উপর বৈদ্যুতিক বাতির আলো জ্বলিতো। বারান্দা হইতে নামিয়া খানিকটা দূরত্বে আলোর ব্যবস্থাসহ পাকা লেট্রিন। সব মিলিয়া আমার মতো গাঁও-গ্রামের বিদ্যুৎ সুবিধা বিহীন ছন্নছাড়া কিশোরের কাছে চমৎকার থাকিবার স্থান মনে হইলো।
৫
অচিরেই লজিং পরিবারটির সহিত আমার একটি সম্মানজনক সুসম্পর্ক হইয়া গেলো। তবে দুইটি বালিকা ব্যতীত। ছোটোটি মাঝে মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতো, কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া অপরটি নহে। উহার মুখটি দেখিতাম সর্বদাই গম্ভীর, তাহার পিতৃদেবের মতোই! চিরকালই আমি ওই সম্প্রদায় হইতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখিয়া চলিবার মানুষ। জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ভ্রাতাদ্বয় দিনদিন আমার খুব অনুগত হইয়া চলিতে লাগিলো। উহাদের মধ্যে এক প্রকার প্রতিযোগিতাও আমার নজরে আসিতে বিলম্ব হইলো না। ইহাদের দুই ভ্রাতার মধ্যে কিছুটা অহি-নকূল সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। উহারা পরষ্পর সরাসরি কথাই বলিতে চাহিতো না। হয়তো কনিষ্ঠ ভ্রাতা কোনো বিষয় লইয়া কথা কহিতেছে; অমনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অতি দ্রুত আমার নিকট আসিয়া নিম্ন অথচ দ্রুত আর উত্তেজিত কন্ঠে কহিতো: “দাদা, জিজ্ঞেস করেন, থামতে কতো চায়।” জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার তোতলানো অভ্যাস ছিলো; ইহার সহিত উত্তোজনা তাহার বক্তব্যকে কিছুটা অবোধগম্য করিয়া তুলিতো। আমি উহাদের কলহ নিবারণে প্রচুর পরিমানে ভাব ধরিয়া পড়াশুনায় আমার জানা উাহাদের দুর্বলতম স্থানে আঘাত করিয়া বিষয়টিতে মনোযোগী হইবার জন্য তাগিদ দিতাম। মধ্যম ভ্রাতাটি খানিন দূরে দাঁড়াইয়া, কোনো পক্ষকেই সমর্থন না করিয়া আমার সহিত অন্যকোনো তৃতীয় বিষয়ে আলোকপাত করিতে সচেষ্ট হইতো। প্রতিদ্বন্দ্বী ভ্রাতাদ্বয়ের মধ্যকার যে বিষয়টি লইয়া সর্বদা প্রকট আকারে প্রতিভাত হইতো তাহা হইলো ইহাদের একমাত্র দ্বিচক্রযানটির ব্যবহার। প্রথম প্রথম এ বিষয়টির ব্যাপারে সমাধান দিতে আমি হিমশিম খাইয়া যাইতাম। এ বিষয়টি এতই জটিল ছিলো যে, এব্যাপারে উহাদের জননীর কথা আর রুলিং তাহারা গ্রহ্য করিতো না। দুই ভ্রাতাই তৎক্ষণাৎ দাবী করিয়া বসিত, “সাইকেলটি এখনই আমার চাই-ই।”
কোনোভাবে ইহার কোনো কিনারা করিতে না পারিয়া একদিন তিন ভ্রাতার সম্মুখেই প্রস্তাব করিয়া বসিলাম, আমি সাইকেল চালনা শিখিতে চাহি। এই একটি মাত্র প্রস্তাবে উহারা তিন ভ্রাতাই সানন্দে সম্মত হইয়া আমাকে ইহার চালনার কৌশল শিখাইতে রাজী হইয়া গেলো।
এক ছুটির দিবসের মধ্যাহ্নে স্নানে যাইবার পূর্বে তিন ভ্রাতাকে সাথে করিয়া বাড়ীর অনতিদূরে উহাদের বিদ্যালয়ের মাঠে গিয়া হাজির হইলাম। ভ্রাতৃত্রয় উহাদের সকল আভ্যন্তরীন কলহ ভুলিয়া গিয়া অতি উৎসাহ আর যাহার পর নাই পরিশ্রম করিয়া আমাকে অর্ধঘন্টার মধ্যেই সাইকেল চালনার প্রাথমিক কৌশল রপ্ত করাইয়া দিলো। আমি উহাদিগকে অবাক করিয়া দিয়া বিদ্যালয়ের মাঠ হইতে প্রায় সিকি কি.মি. যশোহর-খুলনার হাই ওয়ের উপর দিয়া সাইকেল চালাইয়া বাড়ীর উঠানে আসিয়া থামিলাম। ছেলেরা তখনও পিছনে পড়িয়া রহিয়াছে! মাসিমা রান্নাঘরের বারান্দায় বসিয়া আমাকে সাইকেল চালাইয়া আসিতে দেখিয়া অবাক হইলেন, আর তাঁহার মুখখানি হঠাৎ হাসিতে ভরিয়া উঠিলো। তার মুখ হইতে যে বাক্যটি বাহির হইল তাহা হইলো:”মাষ্টামশায় সাইকেল চালানো শিখে ফেলছে!”
৬
নতুন লজিং বাড়ীতে দিনগুলি আমার ভালই চলিতে লাগিলো। সকালে স্নান সমাধা করিয়া অপেক্ষাকৃত কম দূরত্ব হাঁটিয়া বাসে গিয়া উঠিয়া পড়ি। ছাত্র বলিয়া ভাড়া চাইর আনা! এখনকার দিনে ভাবা যায়!? আজকাল পথের বাজার হইতে দৌলতপুর পর্যন্ত বাসভাড়া কতো হইবে? কেহ কি বলিতে পারিবেন? হয়তো ছাত্রদের জন্য কম করিয়া হইলেও আট/দশ টাকা হইবে! নতুন লজিং বাড়ীতে আসিয়াই দৌলতপুরের চিপা বাজার হইতে ৫ টাকা দিয়া একটা সস্তা চেক লুঙ্গী কিনিয়াছিলাম। লুঙ্গীর প্রসঙ্গটা আসিলো তৎকালীন দ্রব্যমূল্য বুঝাইবার জন্য। তবে তাহা খুব একটা কাজে লাগিতো না, কারণ দিনের প্রায় সময়টাই পাজামা পরিয়া কাটিতো। সেই সময়ের এই সব কথা আজ আমার স্পষ্টই মনে পড়িতেছে!
যাহা হউক, সকালে কলেজে যাওয়া। বিকাল তিনটা নাগাদ ফিরিয়া আসিয়া মাসিমার হাতের বাড়িয়া দেওয়া ভাত কাঠের পিঁড়ির উপর ‘বাবু দিয়া’ বসিয়া খাইয়া লইতাম। সাধন স্যারের (অধ্যাপক সাধন ঘোষ) রক্তাক্ত প্রান্তরের ক্লাস থাকিলে ফিরিতে বেলা পড়িয়া যাইতো। কোনো ভাবেই ক্লাসটা মিস করিতাম না। ছোটো খাটো মানুষ, চোখে ভারী লেন্সের চশমা, সাদা ঢোলা পায়জামা পাঞ্জাবিতে অপূর্ব লাগিতো স্যারকে! “ইবড়াহীম কাড়দী” বা “জোহোড়া বেগম” এর মতো উচ্চারণ আমাদেরকে ক্ষুধার কথাকে যেন অবলীলায় ভুলাইয়া দিতো। ইহা ছাড়া আমাদের বাংলার পাঠদান করিতেন স্বনামধন্য অধ্যাপকগণ: কায়কোবাদ স্যার; গণি স্যার শ্রীকান্ত পড়াইতেন। ছিলেন আরও অনেকে। একবার গণি স্যার কোনো কারণে তাঁহার কয়েকটা ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলেন। সম্ভবত: তানজিমা হোসাইন বা জাহানারা ম্যাডাম সেই ক্লাসগুলো নিয়াছিলেন। স্যার ফিরিলে আমাদের অনুযোগের অন্ত রহিলো না। গণি স্যার হাসি মুখে মজা করিয়া বলিয়াছিলেন, “শীড়িকান্ত (শ্রীকান্ত) পড়াতে একজন শীড়িকান্তড়ই পোড়োয়োজন!”
গণিতের অধ্যাপক হারুনুর রশীদ স্যার; তাঁহার লেখা বই হাতে করিয়াই আমরা ম্যাথ ক্লাসে দৌড়াইতাম। ফিজিক্সের লম্বা সুদর্শন আজিজ হাসান স্যারকে দেখিলেই মন ভালো হইয়া যাইতো। প্রানী বিজ্ঞানের তৌফিক স্যার বেশী হলে ৩০ মিনিট ক্লাসে থাকিতেন। টাইট প্যান্ট আর হাফ শার্টের সঙ্গে টাই পরিয়া চক-ডাস্টার হাতে ক্লাসে আসিতেন। ক্লাসের মধ্যে হঠাৎই অনেকটা স্যালুটের মতো ভঙ্গীতে হাত তুলিয়া বিদায় লইতেন। একটা বিষয়ই তিনি পড়াতেন। তবে তাহা আর কখনো আমরা ভুলিতাম না। ইংরেজী পড়াতের সকল বাঘা বাঘা শিক্ষক। এক একজন একটা গল্প পড়াইয়াই মাস কাটাইয়া দিতেন। তাঁহাদের মধ্যে অধ্যাপক শামীম খান ছিলেন উল্লেখযোগ্য। আজ এতো বৎসর পর সকলের চেহারা মনে পড়িলেও নাম মনে করিতে হিমশিম খাইতেছি! বয়েস হইবার কারণে, ইহাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই!
সময় সুযোগ পাইলেই কবিগুরুর শ্বশুরালয়ের নিকট ফুলতলা বাজারে অবস্থিত পোস্ট অফিসে আসিতাম সাইকেল চালাইয়া। কাজটি কলেজেই সমাধা করিতে পারিতাম। ২৫ পয়সায় একটি হলুদ খাম কিনিয়া চিঠি ভরিয়া থুথু লাগাইয়া খামটি বন্ধ করিতাম। তাহার পর ডাক বাক্সে ফেলিয়া দিয়া সাইকেল চালাইয়া ছুটিয়া ফিরিতাম। মূলতঃ সাইকেল চড়িতে পারাটাই থাকিতো আসল, আর একমাত্র উদ্দেশ্য।
৭
এক ছুটির বিকালে কী করিবো ভাবিয়া না পাইয়া, কাহাকেও কিছু না বলিয়া দ্বিচক্রযানটি লইয়া বাহির হইয়া পড়িলাম। সত্য কথাটি হইলো, ইহা আমার শৈশব কালেরই অভ্যাস। অতি শৈশবে পিতার অকাল মৃত্যুর পর হইতেই আমার ছন্নছাড়া জীবনের সূত্রপাত। পিঠা-পিঠি আমরা অনেকগুলো ভাই-বোন। ইহার উপর সংসারে কাজের মহিলার উপর নির্ভরশীল মা হঠাৎ ভাঙ্গিয়া পড়িলো। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আর কেহ রহিলো না। মায়ের বড় সন্তান পলাশদা তখন সবেমাত্র মাতুলালয়ে থাকিয়া হাই স্কুলের ছাত্র। হয়তো সেই সময় হইতেই আমি গ্রামীণ জীবনে এক প্রকার ছন্নছাড়া!
পথের বাজার পূর্বদিকের ছোটো রাস্তাটি হইতে বেশ সতর্কতার সহিত যশোহর-খুলনা হাই ওয়েতে উঠিয়া পড়িলাম। নিশ্চয়ই কালো পিচের রাস্তার পাশ ঘেসিয়া, মাঝে-মধ্যে প্রয়োজনে পাশবর্তী ঘাসওয়ালা মাটিতে নামিয়া ফুলবাড়িয়া গেইটে খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে উদ্দেশ্য করিয়া সাইকেল হাঁকাইয়া চলিলাম। হাঁকাইয়া চলিলাম মানে রাস্তাখানি যখনই ফাঁকা পাইলাম শুধু তখনই। খুব কম সময়ের মধ্যেই কুয়েটের গেইট অতিক্রম করিয়া বিশাল অসম্পূর্ণ ক্যাম্পাসে ঢুকিয়া পড়িলাম। এই ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়াই সকাল-বিকাল পুরাতন লজিং বাড়ী হইতে কলেজে যাওয়া-আসা করিয়াছি। তাই পথ চিনিতে কোনো সমস্যাই হইলো না। একটি আশ্চর্য্য ব্যাপারই শুধু মনে হইতে লাগিলো, আঁকা-বাঁকা গ্রামীণ পথের দূরত্ব যেন হঠাৎ কেমন করিয়া কমিয়া আসিতে লাগিলো। কুয়েট লাগোয়া টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও গভঃ ল্যাবরেটরী হাই স্কুল পাস করিয়া তেলিগাতি গ্রামে আসিয়া পড়িলাম। এখানে রাস্তা-ঘাট সবই কাঁচা, উঁচু-নিচু। এই প্রথম বার খানিকটা কষ্ট অনুভব করিলেও অচিরেই তাহা কাটাইয়া উঠিলাম। দুই একবার সাইকেল থেকে নামিতেও হইলো অনপোযুক্ত পথের কারণে। ইহা ছাড়া কলেজে যাওয়া আসার সময়ে কিছু মুখ আমি চিনিতাম। কখনও বা তাহাদের বাড়ী ঢুকিয়া পিপাসায় জল চাহিয়া খাইয়াছি। গাঁয়ে মাথায় ঘোমটা দেওয়া বধু বা কিশোরী বালিকারা যত্ন করিয়া আমাকে জল দিয়া আমার পিপাসা নিবারণ করিয়াছে। রাস্তার পাশের পুকুরে স্নানরত কতো নারী-পুরুষ বালক- বালিকাকে দেখিয়াছি। তাহারা আমাকে নিয়মিত দেখিতে দেখিতে চিনিয়া ফেলিয়াছিলো বলিয়া আমার বিশ্বাস! আজ কেহ কেহ আমাকে অনিপুণ ভাবে সাইকেল চালাইতে দেখিয়া খানিকটা ফিসফিস করিয়া, স্মিত হাসিয়া আমার পথ ছাড়িয়া দিলো!
এর খানিকটা পরে কিছুটা চিন্তিত হইয়া পড়িলাম। কারণ অচেনা পথ অতিক্রম করিয়া অনুমানের উপর ভিত্তি করিয়া বড় রাস্ততায় ফিরিবার প্রয়াস পাইলাম। তখন বেলা পড়িয়া গিয়া গোধূলী সময় আসিয়া উপস্থিত। লোকের কাছেও জিজ্ঞাসা করিতে লজ্জা বোধ করিতেছিলাম। কারণ উহারা তখন বুঝিবে আমি এখানে একজন আগন্তুক, ইহা বুঝিয়া হয়তো আমার বাহনটিকে কাড়িয়া লইবে।
যাহা হউক, অল্প সময়ের মধ্যে সিমেন্টের তৈয়ারী রাস্তার নাগাল পাইলাম। বুঝিলাম বড় রাস্তার নিকটবর্তী আসিয়া উপনিত হইয়াছি। সামনে একটি বাজার দেখিলাম, দেখিলাম সন্ধ্যায় সেখানে বৈদ্যতিক আলো জ্বলিতেছে। রাস্তায় অনেক লোকের আনাগোনা। হঠাৎ একটা মোড় ঘুরিতে গিয়া একটি ছোটো ছেলের উপর সাইকেল উঠাইয়া দিলাম। সত্যি কথা হইলো আমি তখনও সাইকেলের ব্রেক বস্তুটিকে ব্যবহার করিতে শিখি নাই। ফলস্বরূপ ছেলেটি রাস্তার পাশের নোংরা নর্দমায় পড়িয়া গেলো। আমি সাইকেল হইতে নামিয়া হাত ধরিয়া তাহাকে টানিয়া তুলিলাম। দুই চারিজন লোকও আসিয়া জড়ো হইলো। আমার শরীর ভয়ে কিছুটা যেন কাঁপিতেছিল! দেখিলাম তাহার মুখ দিয়া রক্ত ঝরিতেছে! আমি অমার পকেট হইতে দ্রুত একটি কাগজের এক টাকা বাহির করিয়া দিতেই ছেলেটি মহা খুশী হইয়া লজ্জাবনত মুখে মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলো। তখন দেখিলাম, তাহা রক্ত ছিলো না। সে মুখে পান লইয়া চিবাইতেছিলো আর হঠাৎ পড়িয়া যাওয়ার দরুন মুখ হইতে ইহার লাল কস বাহির হইয়া পড়িতেছিলো যাহাকে ঘাবড়ে গিয়া আমি রক্ত ভাবিয়াছিলা।
আমি টাকা দেওয়াতে গরীব ছেলেটি যেমন খুশী হইয়াছিলো, তেমনি খুশী হইয়াছিলো উপস্থিত দুই চারিজন লোকও। তাহারা আমাকে হয়তো বড় লোকের ছেলে ভাবিয়াছিলো, আমার পোশাক-আশাকের অবস্থা বেশ ভালই ছিলো। আর গায়ের রঙটা এখনকার তুলনায় বেশ খানিকটা ফর্সাই ছিলো!
বড় রাস্তায় উঠিয়া খানিকটা ভয় পাইতে লাগিলাম, কারণ রাতে কখনও যানবাহনের হেডলাইটের আলোয় আমি সাইকেল চালাই নাই। শেষে সন্ধ্যার খানিকটা পরে যখন উঠানের উজ্জ্বল বৈদ্যতিক আলোতে আসিয়া সাইকেল হইতে নামিলাম, দেখিলাম বাড়ীর সবাই বারান্দায় বসিয়া আমার ফিরিবার অপেক্ষায় রহিয়াছে। তাহারা সবাই আমার সম্বন্ধে কী সব চিন্তা করিতেছিলো তাহা আজও আমার কাছে অজানা রহিয়া গিয়াছে। তবে অভ্যাসমত ছোট ছেলেটি আমার কাছ হইতে সাইকেলটি লইয়া বারান্দায় উঠাইয়া ইহার যথাস্থানে রাখিয়া দিলো। আর মাসিমার মুখে দেখিলাম এক স্বস্তির নিঃশ্বাস!
৮
কলেজের এক ছুটিতে বাড়ীতে যাইবার ইচ্ছা হইলো। আমার এক সহপাঠী বন্ধু, যাহার বাড়ীও আমার এলাকায়, ঠিক করিলাম দুই বন্ধু একত্রে খুলনা হইতে লঞ্চ যোগে মোংলায় যাইবো। বন্ধুটি খুলনা শহর লাগোয়া বয়রা নামক স্থানে কোনো এক বাড়ীতে লজিং থাকিতো। কলেজ ছুটি হইবার দিন কথা হইলো আমি ওই দিন সন্ধ্যায় তাহার কাছে গিয়া থাকিবো, আর পরেরদিন দুইজন সকালের লঞ্চ ধরিবো। আমি তাহার প্রস্তাবটি সানন্দে গ্রহণ করিলাম, কারণ তাহার থাকিবার স্থানটি চিনিবারও আমার বেশ আগ্রহ ছিলো। আমরা যাহারা সেন্ট পলস্ স্কুল হইতে এস এস সি পাশ করিয়া বি এল কলেজে ভর্তি হইয়াছিলাম, আমরা সর্বদা সবারই থাকিবার স্থান ও অন্যান্য খোঁজ খবর রাখিতাম। গন্ডগ্রাম হইতে হঠাৎ করিয়া শহরের কলেজে আসিয়া পড়ায় আমরা এই বন্ধনটি ধরিয়া রাখিতাম। আমরা দীর্ঘ্য স্কুল জীবন, সেই ছোটবেলা হইতে হাই স্কুলে সহপাঠী হিসাবে কাটাইয়া আসিয়াছি। আমাদের অভিভাবকরাও চাইতেন আমরা সবার মধ্যে যোগাযোগ রাখিয়া চলি। আমরা ৫ জন সহপাঠী সেন্ট পলস্ স্কুল হইতে বি এল কলেজে আসিয়া বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। ইহাদের মধ্যে হতভাগা আমি ব্যতীত সবাই বর্তমানে সরকারী কর্মে উচ্চ পদে আসীন!
ওই দিন সন্ধ্যার অনেক আগেই আমার লজিং বাড়ী হইতে রওনা হইয়া বাস যোগে বয়রায় বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের নিকটবর্তী স্থানে আসিয়া নামিলাম। হাতে ছোট্ট একটি হাত ব্যাগ। সেই সব দিনে পোষাক-আশাকের কোনো বাহুল্যই ছিলো না। পরনে একটি শার্ট-প্যান্ট আর ব্যাগে দুই একটি টুকি টাকি ব্যবহার্য দ্রব্য। যাহা হউক, বাস হইতে নামিয়া বন্ধুর দেওয়া পথনির্দেশ অনুসরণ করিয়াও কাঙ্খিত বাড়ীটি খুঁজিয়া পাইলাম না। কতো জনকে জিঞ্জাসা করিলাম, বন্ধুর কলেজের নাম ও তাহার দৈহিক বর্ণনা করিলাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হইলো না। আজ এতো বছর পর সেই কিশোর বয়সের অসহায় অবস্থার ছবিটি কেবলই মনের পর্দায় ভাসিয়া উঠিতেছে! এখন ভাবিতেছি, এখনকার সময়ের এই মোবাইলের যুগে এই অবস্থাটা কোনো ব্যাপারই নয়। খুলনা শহরে তখন রাত্রিটা কাটাইবার মতো কোনো লোক বা স্থান আমার জানা ছিলো না। তখন বর্ষা মৌসুমের শেষ দিক। ভিজা পিচ ঢালা ছোট-বড় রাস্তা দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে আমার পা দুইখানা ধরিয়া আসিলো। বড় আসিয়া শহরমুখী একটি মুড়িরটিন খ্যাত নড়বড়ে লোকাল বাসে উঠিয়া বড়বাজারের কাছে আসিয়া নামিলাম। তখন সন্ধ্যা নামিয়া আসিয়াছে। কোনো দিশা না পাইয়া লঞ্চ টার্মিনালে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। মনে মনে হিসাব কষিলাম, রাত অটটার ঢাকা মুখী রকেট স্টীমারে চড়িয়া রাত দশটায় মোংলা পোর্টে গিয়া নামিবো। তারপর যাহা হউক হইবে।
মোংলা হইতে দুই মাইলের বর্ষার কাঁচা কর্দমাক্ত অন্ধকার গ্রামের পথ। পথে একটি ছোটো ও একটি বড় বিপদজনক বাঁশের নড়বড়ে চার ( সাঁকো)। নিচে ক্ষরস্রোতা কাইনমারীর বড় খাল!
যেই ভাবনা সেই কাজ। রকেট টিকেট কাউন্টারে আসিয়া টিকিট কিনিলাম। ভাড়ার কথা যতোদূর মনে পড়িতেছে ১০ টাকা ( কম বেশী হইতে পারে)। ১৯৭৮ সালের ১০ টাকা এখন যদি ১০০ টাকাও হয় তাহলেও আমার মতো গ্রামের উপার্জনশূণ্য কলেজ পড়ুয়া কিশোরের জন্য তা খুবই বেশী ছিলো। তখনকার দিনে অবস্থাপন্ন ভদ্রলোকরা রকেট স্টীমারে যাতায়াত করিতো। বন্দরঘাটে দেরীতে ভেড়া রকেট যাত্রীদের বাড়ী লইয়া যাইবার জন্য পরিবারের লোক বা কাজের লোকরা রাত দশটার আগেই ঘাটে আসিয়া বসিয়া থাকিতো। তবে সব যাত্রীই সাধারণত বন্দরেরই বাসিন্দা থাকিতো।
তখন সন্ধ্যা ছয়টার কিছু বেশী। ভাবিতে লাগিলাম কী করিয়া দুই ঘন্টাকাল বসিয়া কাটাইবো। হঠাৎ মাথায় একটি কু-বুদ্ধি আসিয়া ভর করিলো। হাতের ব্যাগটি লইয়া টার্মিনাল হইতে বাহির হইয়া বৃষ্টিভেজা স্যাঁতস্যাঁতে গলিপথ ধরিয়া পূর্বের একদিনের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করিয়া উল্লাসিনী সিনেমা হলের সামনে আসিয়া দাঁড়াইলাম। তখন ৬টার শো ইতোমধ্যে ১৫/২০ মিনিট হইয়া গিয়াছে। ভিতর হইতে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাটকীয় উচ্চস্বরের সংলাপ আমার কানে আসিতেছিলো। আমি চিরকালই লাজুক। ভয়ে ভয়ে টিকেট কাউন্টারের লোকটিকে টিকেট আর আছে কিনা জিঞ্জাসা করিতেই ডিসি ক্লাসের একটি টিকেট কাউন্টরের ফুঁটা দিয়ে আমার দিকে আগাইয়া দিয়া বলিলো, এই একটাই আছে। আমার সামর্থ্য আছে কী না তাহা না ভাবিয়াই টিকেটটি লইয়া বসিলাম। দাম আজ আর মনে নাই। তবে অন্য সময় হইলে আমি ডিসি ক্লাসের টিকেট কিনিতাম না।
সিনেমা দেখিতে দেখিতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমাইয়া পড়িলাম। সারাদিন ক্লাস করিয়া মুখে সামান্য খাবার গুজিয়া বাহির হইয়াছিলাম। হঠাৎ ইন্টারভেলের গোলোযোগে ঘুম ছুটিয়া গেলো। আমিও উঠিয়া বাহির হইয়া পড়িলাম। আমার পরিকল্পনা ছিলো ৬ টায় আরম্ভ হওয়া শো ৭:৩০টা অবধি উপভোগ করিয়া স্টীমার ঘাটে আসিয়া ৮টায় যাত্রা করিবো। ঘাটে আসিয়া মনটা খানিকটা ভালো হইয়া গেলো। ভালো কাপড়-চোপড় পরিহিত নারী-পুরুষ-ছেলেমেয়ের দল আসিয়া টার্মিনালকে সরব করিয়া তুলিয়াছে। উহারা অধিকাংশ ঢাকার যাত্রী। মোংলার যাত্রী তো কিছু ছিলই। আমি বেশ চনমনে মন লইয়া স্টীমারের দোতলায় উঠিয়া বসিয়া পড়িলাম। খানিক পরে শহীদ বেলায়েত নামের সেই বিশাল রকেট জাহাজ কয়েকবার বোঁ বোঁ করিয়া ভেঁপু বাজাইয়া ছাড়িয়া দিলো।
৯
বেশ ভালই মনে পড়িতেছে, রকেট স্টীমারে তৃতীয় শ্রেণীর সীটগুলি ছিলো লোহার তৈয়ারী। বেশীক্ষণ এক নাগাড়ে বসিয়া থাকিবার উপায় ছিলো না। কিছুক্ষণ পরপর নড়াচড়া করিতে হইতো। এই ভাবেই খানিক পরে চোখ পড়িলো বাম দিকের রেলিং এর দিকে। দেখিলাম কিছু অল্পবয়সী ছেলে-ছোকড়া আবছা অন্ধকারে রেলিং এ ভর করিয়া দেহটিকে ত্রিভঙ্গ করিয়া দাঁড়াইয়া নদীতে পিছনে ধাবমান জলের দিকে তাকাইয়া রহিয়াছে। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন থাকিবার চিন্তা বা প্রয়োজন মানুষ স্বপ্নেও কল্পনায় আনিতো না। ওই সময়ের দেশের অর্থনীতি বলিতে যাহা ছিলো তাহা হইলো অসংখ্য গরীব মানুষ কোনো রকমে খাইয়া না খাইয়া জীবন কাটাইতো। আমার মত হইল, এখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি: অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মধ্যে সব চেয়ে বড় অর্জন বস্ত্র খাত। দেশের সকল মানুষের যে অভাবটি সম্পূর্ণভাবে মিটিয়াছে তাহা হইল বস্ত্র সমস্যার অকল্পনীয় সমাধান! আজকাল দিন মজুর বা গৃহকর্মে নিযুক্ত যুবক-যুবতীরা যে স্টাইল ও মানের পোষাক পরিয়া চলাফেরা করে তাহাতে উহাদের দেখিয়া কোনো ভাবেই ঠাহর করিবার উপায় থাকে না যে তাহারা অল্প লেখাপড়া জানা লোক বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারেই অশিক্ষিত বা নিরক্ষর। সহজলভ্য স্বল্পমূল্যের অথচ দৃষ্টিনন্দন জিন্স ও টি-শার্ট এবং দেশীয় কাপড়ের সালোয়ার-কামিজের চাকচিক্যে সবাইকে বেশ সুদর্শন-সুদর্শনা লাগে।
যাহা বলিতেছিলাম, মোবাইলের যুগ হইলে হয়তো উহারা রেলিং এ দাঁড়িয়ে তাহাতে একদৃষ্টে মনোনিবেশ করিয়া টেপাটিপি কর্মে ব্যস্ত থাকিতো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার মতো অস্বচ্ছল পরিবারের কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা তখন খুলনা শহরের নিক্সন মার্কেট হইতে বিদেশ হইতে আসা বিদেশীদের ফেলে দেওয়া বড় সাইজের মন ভুলানো কাপড়ের প্যান্ট ও শার্ট ২০/২৫ টাকায় ক্রয় করিয়া দর্জির নিকট লইয়া গিয়া অল্টার করাইয়া প্যান্টের উপরে টাইট ও নিচে বিশাল ঢোলা রাখিয়া রীতিমতো বড়লোকের ছেলেদের সাথে তালমিলাইয়া চলিবার চেষ্টা করিতো।
সেদিন দেখিলাম একটি ছেলে একটু ভিন্ন ধাঁচের প্যান্ট-শার্ট পরিয়া, অল্টার করা নয়, যেন স্থানীয়ও একদম নয়, কেমন ঢাকা হইতে আসিতেছে ভাব করিয়া রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। অল্প আলোতে খানিকটা দূর হইতে দেখিয়া কেমন চেনা চেনা মনে হইতে লাগিলো। খাটো শরীর, বেল বটম আনকোরা প্যান্ট, পায়ে হাই হীল ঘোড়াক্ষুর স্টাইলের জুতা!
খানিকটা সাহস সঞ্চয় করিয়া ধীরপদে উহার কাছে গিয়া দাঁড়াইলাম। ইতোমধ্যে কলেজে নূতন ছেলেদিগের সহিত পরিচিত হইবার কৌশলটি শিখিয়া ফেলিয়াছিলাম। খানিকটা ভালো করিয়া দেখিয়া, নিশ্চিত হইয়া তাহার উদ্দেশ্যে বলিলাম, এই তুমি মিন্টু না (তাহার সত্যি নাম নয়)?
সে আমার দিকে চাহিয়া কেমন অপরিচিত হইতে অনেক কষ্টে অল্প আলোতে চিনিতে পারিয়া কোনো রকম উত্তেজনা ব্যতীত উচ্চারণ করিলো, ও দীপক! ইহার পর বেশী না হইলেও খানিক থামিয়া, খানিক বরতি দিয়া দিয়া কিছু কথা হইলো। আমার বিষয়ে তেমন আগ্রহ তাহার মধ্যে দেখিলাম না। আমি কোথা হইতে আসিতেছি তাহা জানিতে চাওয়াতে আমি আমার বি এল কলেজের কথা বলিলাম। ইহাতে সে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাইলো না। আমার প্রশ্নে জানাইলো সে ঢাকা হইতে আসিতেছে। ঢাকার তেজগাঁও কলেজে বোনের বাসায় থাকিয়া পড়াশুনাা করে। আমি খানিকটা আমার অধিকার ও দায়িত্ব বোধের মধ্যে পড়ে বিধায় সেন্ট পলস হইতে বি এল কলেজে আমার ৪ সহপাঠীর কথা বলিলাম। সে শুধু হুঁ হ্যাঁ করিয়া গেলো। সেন্ট পলস্ স্কুলে সে ষষ্ঠ্য শ্রেণী হইতে এস এস সি পাশ করা পর্যন্ত আমার সহপাঠী ছিলো। ছাত্র হিসাবে মোটামুটি গোছেরও খানিকটা নিচে তাহার অবস্থান ছিলো। আমি শুধু ভাবিতেছিলাম কী এমন ঘটিলো যে সে আমাকে এতো এড়িয়ে যাইতেছে! এতোদিন পর এই একটি কথাই বারংবার আমার মনে হইতেছিলো। ওই বিশেষ অর্থনৈতিক অবস্থার সময়ে কিছু মানুষ তাহাদের স্বচ্ছলতার কারণে নিজেদেরকে আলাদা ভাবিবার প্রয়াস পাইতো। আর ঢাকা তখন স্বপ্নের শহর। এসব বিবেচনায় আনিয়া সেদিন সে হয়তো তাহার অতি পরিচিত সহপাঠী যে পড়াশুনায় মোটেও মন্দ ছিলো না, অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল, তাহাকে গুরুত্ব দিতেছিলো না! তেজগাঁও নামটা শুনিতাম খবরে। সেখানকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা, তেজগাঁও বিমানবন্দর, আরও কতো কী! তবে কলেজ হিসাবে সেই সময়ের তেজগাঁও কলেজ কেমন ছিলো তাহা আজ বুঝিতে পারি।
ইহারই মধ্যে আমার দুই ঘন্টার প্রমোদতরীর বিহার শেষ হইলো। মোংলাপোর্টের আলোক ঝলমলে ঘাট চোখে পড়িলো।
রাত তখন ১০টা। মনে মনে ভাবিলাম, সে যেমনই হোক, এই রাত্রি বেলা একজন পথের সঙ্গী তো পাওয়া গেলো! তাহার বাড়ী আমারই গ্রামে, তবে এক কিলোমিটারের মতো দূরত্বে।
রকেট আসিয়া আবারও বোঁ বোঁ ভেঁপু হুঁংকারে ঘাটে ভিড়িলো।
১০
স্টীমার হইতে খালাসীদের তৎক্ষণাৎ পাতানো কাঁঠের পাটাতন সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া পড়িলাম। কলেজে পড়ি, অনেকদিন পর বাড়ী ফরিতেছি, মনের মধ্যে একটা গুরুত্ব অনুভব করিতে লাগিলাম। কারণ পড়াশুনার জন্য জীবনের প্রথম বাড়ীর বাহিরে দূরে কোথাও বাস করা। ঘাটে অপেক্ষমান লোকেরা যেন সবাই আমাকে দেখিতেছে — এমন অনুভূতিও বেশ খানিকটা অনুভূত হইতে লাগিলো। তরতর করিয়া নামিয়া ঝটপট করিয়া ঘাটের ছোটো রাস্তাটি পার হইয়া প্রধান সড়কে আসিয়া পড়িলাম। প্রধান সড়ক বলিতে সিমেন্টের তৈয়ারী পাকিস্তান আমলের ঢালাই ভাঙ্গা-চোরা রাস্তা। শুধু মাত্র লোক চলাচলের জন্য নির্মিত। তখন ছিলো না কোনো রিক্সা, রিক্সা-ভ্যান এমন কি ঠ্যালাগাড়ীও। তবে যানবাহনের মধ্যে শুধু কিছু দ্বিচক্রযান ছিলো হাতে গোনা
কিছু মানুষের ব্যক্তিগত বাহন হিসাবে। আমরা হাঁটিতে লাগিলাম, তেমন আন্তরিক কথাবার্তা ছাড়াই। মোংলার তখনকার একমাত্র সিনেমা হল রিমঝিম পার করিয়া শেহালা বুনিয়া গ্রামে আসিয়া পড়িলাম।
ইট বিছানো রাস্তা ধরিয়া হাঁটিবার সময় আমার সাবেক সহপাঠী সুহৃদ হঠাৎ কেমন বেসুরো গলায় বলিয়া উঠিয়া জানন দিলো যে সামনে সে তাহার মাসি বাড়ীতে থাকিয়া যাইবে। আমি ভয়ে তাহার কথার কোনরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করিবার পূর্বেই বিনা নোটীসে সে হাতের বাম দিকের একটি আধা ভাঙ্গা বেধড়ক গলিতে হালকা অন্ধকারে ঢুকিয়া পড়িলো। কিশোর বয়সের অপরিপক্ষ অহঙ্কারী স্বার্থপর বন্ধুত্ব অচেনা ঢাকায় বসবাস করিবার কারণে তাহার মধ্যে প্রচুর পরিমানে তখন ক্রিয়াশীল থাকিবার ব্যাপারটি পরিষ্কার বুঝিতে না পারিলেও এই ছন্নছাড়া কিশোরের মনে তাহা উপলব্ধি করিবার ক্ষমতার বাহিরে রহিলো না। এই গলিটি আজও এ সব কথা লিখিবার সময় আমার চোখের সামনে জ্বল জ্বল করিতেছে। এর একটু সমুখে অগ্রসর হইয়া ডান হাতে আমার কতো পরিচিত সেন্ট পলস হাসপাতাল, আর আরও খানিকটা এগিয়েই ডান পাশে আমার প্রাণপ্রিয় সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালের ছোট পকেট গেট সহ বৃহৎ লোহার গেট। এসব অতিক্রম কালে আমার মন হইতে কেমন করিয়া যেনো এতো রাতে একাকী চলিবার ভয়টি সাময়িক ভাবে তিরোহিত হইয়া গেলো। স্কুলের পিছনের নারিকেল গাছের ফাঁক দিয়া স্কুলের ইউরোপীয় ঢঙে তৈয়ারী দ্বিতল ভবনটি আমাকে অফুরন্ত সাহস যোগাইলো। এর পরই রাস্তার বাম পাশেই আমার শিক্ষক অমর পিটার স্যারের বাসস্থান। আরও খানিকটা এগিয়ে শিক্ষক মান্নান সাহেবের বাসা। মনে হইতে ছিলো এতো রাত্রে কোনো বিপদ-আপদ হইলে তাঁহাদের দরজায় দাঁড়াইয়া স্যার বলিয়া জোরে ডাক দিলে স্যারেরা সাড়া না দিয়া পারিবেন না। কারণ ছাত্র হিসাবে সকল শিক্ষক মহোদয়দের সহিত আমার শুধু চেনা জানা নয়, বরং একটি সুসম্পর্কও বিদ্যমান ছিলো প্রায় ৫ বছরের স্কুল জীবনে। তাঁহারা যে আমাকে ভুলিয়া যান নি তাহা পরবর্তী অনেক বারই বিভিন্ন অবস্থান থেকে প্রমাণিত হইয়াছিলো।
শাঁখারী পুকুর পার হইয়া ডান দিকে নামিয়া পড়িলাম। এর পর কদু বাবুর বাড়ীর সমনে দিয়া ডান দিকে মোড় লইয়া প্রধান শিক্ষক সুদান বাবুর বাড়ী। এখানেও বড় সাহসের জায়গা। রাস্তার কাছেই স্যারের চৌচালা টিনের ঘর। বাড়ীর সামনেই একটি ছোটো কাঁঠের সাঁকো। সাঁকো পার হইয়া L আকারের মোড় ঘুরিয়া কাইনমারীর খালের সাঁকোর কাছে আসিয়া পড়িলাম। আকাশে তখন চাঁদ উঠিয়াছে। চাঁদের আবছা আলোয় ভর করিয়া অতি সাবধানে সাঁকোটি পার হইলাম। খালের ওই পার হইতে কাদামাখা ভাঙা মাটির রাস্তা। রাস্তা বলিলে ভুল বলা হইবে। এই রাস্তা ঠেলিয়া বর্ষাকালে হাঁটু কাঁদা ভাঙ্গিয় প্রতিদিন ছোটো পায়ে দুই হাঁটুর উপর ভর করিয়া দুইবার স্কুলে যাওয়া-আসা করিয়াছি। ভয়টা কেমন সহিয়া আসিয়াছিলো।
সামনে রাস্তার বাম পাশে ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসের একতলা জীর্ণ ভবন। মাটির রাস্তার দুই পাশ ঘেঁষা গ্রামের ঘরবাড়ী, খড়ের গাদা আর উঠান। সামনে বাম পাশেই অঙ্কের অতুলনীয় শিক্ষক অনিল বাবুর বাড়ী, এর খানিক পরে বিজ্ঞানের নির্ভরযোগ্য শিক্ষক কালিপদ বাবুর বাড়ী। তখন ভয় ছিলো না বলিলেই চলে। দুই একটি বাড়ীতে হারিকেনের টিমটিমে আলোর সহিত বাচ্চাদের কান্না আর বয়স্কদের মৃদু কাশির আওয়াজ কানে আসিতে লাগিলো। হাঁটিতে হাঁটিতে কাইনমারী গ্রাম ফেলিয়া হলদিবুনিয়া গ্রামের উত্তর প্রান্তে প্রবেশ করিলাম।
১১
হলিবুনিয়ায় ঢুকিয়াই দুইদিকে বাঁশঝাড় সহ অন্যান্য নানাবিধ গাছ-পালায় ঘেরা ঘন বাগান। মাঝখান দিয়া গাছের পাতায় মজিয়া যাওয়া মাটির স্যাঁতস্যাঁতে ভিজা কমবেশী শত মিটারের একটি রাস্তা। রাত্রিকালীন সময়ের জন্য সংক্ষিপ্ত কিন্তু ভয়ের একটি পথ। দিনের বেলায় এক প্রকার ছায়াঘেরা সূর্যের আলো না পৌঁছানো এক উত্তম প্রকৃতিগত শীতল ব্যবস্থা। আকাশে চাঁদ থাকিলেও কেমন ঘুঁটঘুঁটে অন্ধ্যকারের ভিতর দিয়া এই স্বল্প দূরত্ব অতিক্রম করিতে আমার বেশ সময় লাগিলো। বাম দিকে বাঁক লইতেই অমর বাবুদের বিশাল জায়গা নিয়ে বাড়ী। আমার প্রিয় শিক্ষক! তিনি আজ আর এ পৃথিবীতে নাই। তাঁহার সহিত ছাত্র হিসাবে আমার সম্পর্ক আর নানাবিধ গল্প-ঘটনা লিখিবার জন্য আলাদা একটি পর্বেও জায়গার সঙ্কুলানের অভাব ঘটিবে।
বাড়ীর সামনেই শুরুতে একটি কাঁঠের তৈয়ারী গ্রামীণ পদ্ধতিতে নির্মিত বাঁধা, এক এক করিয়া দুইটি পা’কেই খানিকটা কসরত করিয়া বেরিয়ারটিকে পার হইতে হইলো। দ্বিতীয় বাঁধাও একই রকম আর একই প্রকারে পার হইলাম। এর পর কিরণ বাবুর পুকুর, রাস্তা লাগোয়া। সবাই ওনাকে ডাক্তার বাবু বলিয়াই চিনিতো। তিনিও আজ আর বাঁচিয়া নাই। আমার ছোটোবেলায় জ্বরে পড়িলে বিস্তর কাদা ভাঙ্গিয়া মা তাহার কিরণ মামার কাছ হইতে লাল রঙের হাতে বানানো সিরাপ লইয়া যাইতো। ঔষধের শিশিতে সাদা কাগজ কাটিয়া দাগ চিহ্নিত করিয়া আটা দিয়া লাগাইয়া দিতেন। হয়তো এক সপ্তাহর কালের জন্য। জ্বোরো শরীরে সেই লাল সিরাপের স্বাদ আজও আমার মনে পড়ে! কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ। এখানেও গাছপালায় ভরা। বাম হাতে বিমল বাবুর দোতলা টিনের ঘর, সামনে পুকুর। ধনী পরিবার তাঁহার; বাড়ীতে বন্দুক আর কুকুর থাকিতো। এতো রাত্রে ছেড়ে রাখা কুকুরের সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে বিমলদার বাড়ী পার হইয়া আমার জন্য অত্যন্ত ভয়ের জায়গার সূচনায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। এইখান হইতে অর্ধ কিলোমিটার ফাঁকা জায়গার কাদা রাস্তা পার হইতে পারিলেই আমাদের বাড়ী।
১২
সমুখ পানে একদন্ড চাহিয়া লইলাম। মাটির এ রাস্তাটি চলিয়া গিয়াছে মালগাজীর তহসিল অফিস এবং এর কাছেই হাট পর্যন্ত। পথের উভয় দিকেই উন্মুক্ত ধান ক্ষেতের বিল। রাস্তার দুই ধার ধরিয়া ছোট বড় গেউয়া গাছের সারি। এখান হইতে আমাদের বাড়ী পর্যন্ত একদম ফাঁকা, অন্য কোনো ঘর-বাড়ী নেই। এখন চাঁদের অপেক্ষাকৃত বেশী আলোতে পথের কাদা কেমন উজ্জ্বলতর ভাবে দৃশ্যমান হইলো, এবং আমাকে এক প্রকার সাহসও যোগাইলো। হাঁটিতেছিলাম সতর্ক ভাবে যতো দ্রুত সম্ভব। অকস্মাৎ একটি অদ্ভুত বিকট শব্দে আমার কিশোর অন্তর আত্মা প্রবল ভাবে কাঁপিয়া উঠিলো! নিজেকে প্রাণপণে সম্বরণ করিয়া শব্দের উৎসের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, খেঁজুর তলার ভিটা; একটা খেঁজুর গাছ কতো কাল ধরিয়া সেখানে সঙ্গীহীন অবস্থায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছে! খেঁজুর গাছটিকে আলো-আঁধারে কেমন বিশাল লম্বা এক পায়ে খাঁড়া ভুতের মতো মনে হইতে লাগিলো। এই পথ দিয়া কতোবার আসা যাওয়া করিয়াছি, কখোনও একবার এই গাছটির দিকে ভালো করিয়া তাকাইয়া দেখি নাই। দেখিলাম গাছটি হইতে সামান্য দূরত্বে একটি ঘোড়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। হয়তো ঘুমের মধ্যেই প্রায় মধ্যরাত্রিতে খানিক দূরত্বে আচমকা এক মানব সন্তানের দুর্বল উপস্থিতি টের পাইয়া প্রতিরোধের প্রস্তুতি হিসাবে তাহার নাসারন্ধ্র দ্বারা এই বিকট শব্দটি করিয়া থাকিবে। ঘোড়াটি সম্ভবত:আমার গ্রামের খ্রীস্টান পাড়ার সরকারদের। তাহারা রাতে প্রয়োজন না পড়িলে ঘোড়া বাড়ীতে লইয়া যাইবার প্রয়োজন বোধ করিতো না। আমি ব্যাপারটি বুঝিতে পারিয়া নিজেকে প্রবোধ মানাইয়া আচমকা আ…! ই…! কথায় তাৎক্ষণিক তৈয়ারী সুর সহযোগে একটি বেসুরো গান ধরিয়া বসিলাম! ছোট বেলায় আমার বাড়ীর সমুখ দিয়া সন্ধ্যারাতের পরে অজানা অচেনা কতো লোককে যে এইরূপ গান গাহিয়া চলিয়া যাইতে শুনিয়াছি, তাহার কোনো হিসাব নাই।
ইহার পর চোখ গেলো মালগাজী হলদিবুনিয়া এলাকা বিভক্তকারী খালটির দিকে। কেয়া আর হরগেজা কাঁটার ঝোপ দিয়া দুইকূল ঢাকা। শৈশবে খেলার ছলে সমবয়সী বালকদের সহিত এ খালে কতো মাছ ধরিয়ছি গামছা ছাঁকিয়া, ‘বাউলো’ ফল খুঁজিয়া মরিয়াছি গেউয়ার ঝোঁপে ভর দুপুরে, ‘কুড়োর খা’ দিয়া খেপলা জালে ধরিয়াছি কতো দিন ‘ঘুসো’ চিংড়ি! তবে আজ ভয় হইতেছিলো অন্য কারণে। গ্রামের অতীতে মারা যাওয়া অনেকের দেহ হিন্দু মতে এ খালের পাড়েই দাহ করা হইয়াছিলো। বিষয়টি আমার শিশুকালের চাক্ষুস অভিজ্ঞতারই অংশ! আমি এসব কথা ভাবিতে ভাবিতে বাড়ীর নিকটবর্তী আসিয়া পড়িলাম। আমি তখন বাড়ীতে ঢুকিবার মাত্র একশত গজের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি, রাস্তাটি এই অংশ হইতে সংস্কারকৃত এবং নূতন ছোটো ঘাসে আবৃত, হঠাৎ অনুভব করিলাম কেউ আমাকে নীরবে অনুসরণ করিতেছে! আমি এক মুহূর্ত থমকিয়া দাঁড়াইলাম। হাতের ছোটো ব্যগটি শক্ত করিয়া ধরিলাম, পিছন ফিরিয়া তাকাইলাম, দেখিলাম চার পাঁচ গজ দূরত্বে একটি কালো কুকুর দাঁড়াইয়া। অস্পষ্ট তার অবয়ব! আমি একবার ‘হাই’ (স্থানীয় পন্থা) আওয়াজ করিয়া উহাকে তাড়াইতে চাহিলাম, সে বিন্দু মাত্র প্রতিক্রিয়া না দেখাইয়া ঠায় দাঁড়াইয়া রহিলো! আমি তখন দুই পা আগাইয়া আবার পীছনে তাকাইলাম, সেও কেমন বেহায়ার মতো নির্লিপ্ত থামিয়া গেলো! আমার সমস্ত শরীরের ভিতর দিয়া এক রকম ভীতিকর শিরশিরানি অনুভূতি স্রোত বহিয়া গেলো! আমি কাল বিলম্ব না করিয়া অসম্ভব মনোবল লইয়া বাড়ীর সীমানায় ঝুলানো দরজা সরাইয়া ঢুকিয়া পড়িলাম।
আজ এই দীর্ঘ প্রায় ৪০ বৎসর পর, আমি ঢাকায় বসিবার ঘরে দিবালোকে বসিয়া যখন এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথাগুলি লিখিতেছিলাম, তখনও সেই শিরশির করা ভীতিকর একই অনুভূতি খানিকটা হইলেও আমার শরীরের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া গেলো! আমি লাজুক প্রকৃতির, যুক্তিবাদী, প্রমাণ ছাড়া অসম্ভব, অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা অতি কাছের মানুষকেও বলিবার অভিপ্রায় আমার কখনও হয় না। আজ এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে সুযোগটি গ্রহণ করিয়া জ্বলন্ত সত্য, অথচ অসম্ভব প্রায় ঘটনাটি প্রকাশ করিবার সুযোগটি গ্রহণ করিলাম। এখন না পারিলে আর কোনো দিনই হয়তো ইহা প্রকাশ করা সম্ভব হইতো না!
লেখক পরিচিতি

দীপক রায় – পূর্ণ নাম: দীপক কুমার রায়। জন্ম এস এস সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ৭ই জানুয়ারী, ১৯৬৩। বৃহত্তর খুলনার অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় মালগাজী গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় শ্রী ধনঞ্জয় রায় এবং মা শ্রীমতি অমলা রায়। মোংলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার দৌলপুরে সরকারী ব্রজলাল কলেজ থেকে যথাক্রমে এস এস সি এবং এইচ এস সি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
চাকরি জীবন শুরু ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর, ঢাকায় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার একটা স্কুলে সিনিয়র ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার হিসাবে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ওই চাকরি থেকে ইস্তাফা দিয়ে বর্তমান পর্যন্ত স্বনিযুক্ত প্রশিক্ষক হিসাবে বিদেশী শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা ভাষার শিক্ষাদানের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। এক ছেলেও এক মেয়ের বাবা। ছেলে সুদীপ্ত রায় ঢাকার একটি বৃহত্তর বেসরকারী হাসপাতালে রেজিস্ট্রার ডাক্তার হিসাবে কর্মরত। মেয়ে শর্মিষ্ঠা রায় পরিবেশ বিজ্ঞানে সম্মান সহ সম্প্রতি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিয়েছে।
বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতে গভীর ব্যুৎপত্তি ও অনুরাগসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী দীপক রায়। তাই কাজের ফাঁকে নিজের সন্তুষ্টির জন্য লেখা-লেখি নিয়ে সময় পার করেন। ফেসবুকে জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে কবিতা লিখে থাকেন প্রতিদিনই, নিয়মিত। গান শোনা তাঁর অন্যতম প্রধান শখ। বিশেষতঃ রাগ প্রধান গান – এ উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ব্যপক আগ্রহ। যখনই অবসর পান গান শুনে সময় কাটানোই তার নিয়মিত অভ্যাস।