আজ হিরোশিমা দিবস।
দিবসটির ৭৫তম বার্ষিকী। ১৯৪৫ সালের এই দিনে পরমাণূ বোমা প্রথম আঘাত হানে মানুষের উপর। সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর ৭৪ বছর কেটে গিয়েছে – কিন্তু সেদিন যে পরমাণু বোমায় হিরোশিমা কেঁপে উঠেছিল পৃথিবীর মানুষেরা তা ভুলে যায় নি। এই বিস্ফোরণে প্রায় এক শত চল্লিশ হাজারের মত মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং তেজস্ক্রিয়তার প্রতিক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে হিরোশিমায় মারা যায় আরো দুই শত সাইত্রিশ হাজার জনের মত।
ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর। ইউরোপ এবং অনত্র ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেও আমেরিকা এই যুদ্ধে তখনও যোগ দেয়নি। এই দিন ভোরে অপ্রত্যাশিত ভাবে জাপান নৌবাহিনীর বিমান আমেরিকার হাওয়াই-এর পার্ল হারবার আক্রমণ করে। ৬টি বিমানবাহী জাহাজে ৩৫৩টি যুদ্ধ বিমান, বোমারু বিমান এবং টর্পেডো বিমান আমেরিকার এই নৌঘাটিতে এক যোগে লাগাতা আক্রমণ করে। আমেরিকা অপ্রস্তুত থাকায় জাপানীদের দুর্ধর্ষ এই আক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোন উপায় ছিলো না। অতি গোপনীয়তায় এই আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল এবং মৃত্যু পণ করে এই আক্রমণ পরিচালনা করে জাপানী পাইলটেরা। তাৎক্ষনিক ভাবে চারটি আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজ ডুবে যায় এবং আরো চারটি আমেরিকান যুদ্ধজাহাজের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এই জাহাজগুলির মধ্যে বিমানবাহী জাহাজ ছিল এবং এ বিমান আক্রমণে ১৮৮টি আমেরিকান বিমান ধবংস হয়। মারা যায় ২,৪০২ জন এবং আহত হয় ১,২৮২জন। জাপানীদের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি – তাদের মাত্র ২৯টি বিমান ভূপাতিত হয় এবং ৫টি সাবমেরিন ডুবে যায়। মাত্র ৬৫ জন নিহত বা আহত হয় এবং একজন জাপানি নাবিক ধরা পড়ে।
এই আক্রমণের ফলে আমেরিকায় যেন বারুদ জ্বালিয়ে দেয়া হলো। জাপানীদের এই আক্রমণ আমেরিকায় বিপুল দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলে এবং এতদিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাইরে থাকলেও পরদিনই (১৯৪১ সালের ৮ই ডিসেম্বর) আমেরিকা জাপানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেই থেকে জাপানকে দাঁতভাঙ্গা জবার দেবার জন্য আমেরিকান সরকার ভীষণভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এই সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় সমরসজ্জ্বা। এরই ফলশ্রুতি হিসাবে আমেরিকা পরমাণু বোমা তৈরির দিকে নজর দেয় এবং সফলও হয় বোমা তৈরিতে। এবং জাপানকে শিক্ষা দেবার জন্য সেই পরমাণু বোমার সর্বপ্রথম বিস্ফোরণ ঘটানো হয় হিরোশিমায়।
হিংসা এবং প্রতিহিংসা মানুষদেরকে দানব করে তোলে। পার্লহারবার আক্রমণ এবং তার ফলশ্রুতিতে হিরোশিমায় সাধারণ মানুষের উপর পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ তারই সাক্ষ্য। তবে এই ভয়াবহতা মানুষদের ভিতর চেতনার ও আশারও সঞ্চার করেছে। ইতিমধ্যে আরো পারমাণবিক বোমা সহ নানা ধরণের ভয়াবহ অস্ত্র তৈরি হলেও বিশ্বের ইতিহসে এখনো পর্যন্ত এসব অস্ত্র প্রয়োগ আর কখনো হয়নি। বরং শান্তির চেতনায় উদবুদ্ধ হয়ে ১৯৬৪ সালে জাপানের হিরোশিমায় পরমাণু বোমা আক্রান্তকারীদের স্মরণে জ্বালানো হয়েছে “শান্তির শিখা” বা “The Flame of Peace” – বিশ্ব থেকে পরমাণু অস্ত্রের অস্তিত্ব দূর না হওয়া পর্যন্ত জ্বলবে এই শিখা।
জনসাধারণের মধ্যে এত চেতনা সত্ত্বেও পরমাণু বোমার ভয়ংকর পরিনতির সম্ভাবনা থেকে পৃথিবী মুক্ত নয় এখনো। অনেক দেশ এখন পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী এবং বেশ কিছু দেশের সরকার গোপনে হলেও এখনো পরমাণু অস্ত্র আয়ত্বের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর ভবিষৎ কোথায় – শান্তিতে কিংবা ধ্বংসে – ভবিষৎ নিশ্চয় তা বলে দেবে। কিন্তু আশা রইল চেতনা ও সুবুদ্ধি যেন প্রতিষ্ঠা পায়, এ বিশ্ব যেন শান্তির ও কল্যাণের হয়ে ওঠে। আজকের এই হিরোশিমা দিবসে সেই প্রার্থনাই যেন পূর্ণ প্রাণে পূর্ণতা পায় সবার অন্তঃকরণে।
-অনুপ মজুমদার